অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও ঘটছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়েও দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধানী দলের প্রতিবেদনে এবিষয়ে বলা হয়, আগস্টের শুরু থেকে পরবর্তী সময়ে সহিংস মব (বিশৃঙ্খল জনতা) পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে নিশানা করে হত্যাসহ গুরুতর প্রতিশোধমূলক কর্মকাণ্ড করেছে। এ সময় হিন্দু, আহমদিয়া মুসলিম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরাও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন। তাঁদের বাড়িঘরে হামলা ও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। হামলা হয়েছে মাজার, মন্দিরসহ ধর্মীয় স্থাপনায়। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, এমন ব্যক্তিদের এসব অপরাধের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে ভুক্তভোগীদের মানবাধিকার রক্ষা করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।

জেনেভায় প্রকাশিত তথ্যানুসন্ধানী দলের প্রতিবেদনে আরো জানানো হয় , বাংলাদেশ দীর্ঘ সময় ধরে বিচারহীনতা ও প্রতিশোধের চক্রের মধ্যে আছে। আগস্টের শুরু থেকে যাঁরা প্রতিশোধমূলক সহিংসতা এবং নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠী ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন–নিপীড়ন চালাচ্ছেন, তাঁদের অনেকে দৃশ্যত এ দায়মুক্তি পাচ্ছেন। গত বছরের ১৪ অক্টোবর সরকার ঘোষণা দেয় যে ‘শিক্ষার্থী ও জনতা, যাঁদের কারণে গণ–অভ্যুত্থান সফল হয়েছে, তাঁরা কোনো বিচার, গ্রেপ্তার ও হয়রানির সম্মুখীন হবেন না। বেশির ভাগ সহিংসতা আত্মরক্ষার্থে ও তুমুল উসকানির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসেবে ঘটেছে’। কিন্তু ওএইচসিএইচআর মনে করে, হত্যা, যৌন নিপীড়ন, লুটতরাজ, আবাসিক ভবনে অগ্নিসংযোগ এবং জাতিগত, ধর্মীয় ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার ক্ষেত্রে দোষীদের ছাড় দেওয়া যাবে না।

প্রতিবেদনে ৫ আগস্ট–পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হত্যা, থানায় হামলা–অগ্নিসংযোগ, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মারধর ও হত্যা, নারীদের যৌন হয়রানি, ধর্ষণ এবং আওয়ামী লীগের নেতা–সমর্থকদের বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, হিন্দু, আহমদিয়া সম্প্রদায়, পাহাড়ের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ওপর হামলা, মাজার ও মন্দির ভাঙচুর, আগুন দেওয়া, সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ও সাংবাদিকদের ওপর হামলার বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ৮ আগস্ট ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনরুদ্ধারে অগ্রাধিকার দেয়। অস্থায়ীভাবে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও আনসার-ভিডিপি সদস্যদের পুলিশ স্টেশনে মোতায়েন করা হয়। কয়েক দিন পর সরকার পুলিশের কার্যক্রম আবার সচল করতে সক্ষম হয়। যদিও পুলিশের কার্যকারিতা তখনো সীমিত ছিল। প্রতিশোধমূলক হামলা ও সহিংসতা পুরোপুরি প্রতিরোধ করতে পারেনি সরকার। দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম কয়েক দিনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা জনগণকে সব ধরনের সহিংসতা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে শান্ত থাকতে বলেন। বিশেষ করে সংখ্যালঘু মানুষদের ওপর হামলার নিন্দা করেন এবং তরুণদের হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের রক্ষার জন্য এগিয়ে আসতে বলেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানবাধিকারের প্রতি বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকারকে অন্যের দ্বারা গুরুতর নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তির জানমালের নিরাপত্তা দিতে হবে। একই সঙ্গে যথাযথ নিয়ম মেনে দ্রুততার সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে আওয়ামী লীগ–সমর্থক, পুলিশ কর্মকর্তা এবং নির্দিষ্ট ধর্মীয় ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের ওপর হামলার তদন্ত করতে হবে। যদিও এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিতের লক্ষ্যে যেসব তথ্য চাওয়া হয়েছিল, সেগুলো সরবরাহ করা হয়নি। সরকার প্রকাশ্যে জানিয়েছে যে সংখ্যালঘুদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় অন্তত ১০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে; কিন্তু আওয়ামী লীগ–সমর্থক বা পুলিশ কর্মকর্তাদের ওপর প্রতিশোধমূলক সহিংসতার ঘটনায় মোট কতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সামগ্রিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করেনি সরকার।

অন্তর্বর্তী সরকার পূর্ববর্তী সরকারের আমলে সংঘটিত গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত আদালতের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) মামলা করা হয়েছে। তবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বিচার বিভাগে আগে থেকে চলে আসা কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে এসব প্রচেষ্টা বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গণহারে দেওয়া মামলার ওপর ভিত্তি করে কার্যকারিতা নেই, এমন অভিযোগ আনার মতো পুলিশের নানা খারাপ চর্চার ঘটনা ঘটছে।

পুলিশের তথ্য অনুসারে, ১ হাজার ১৮১টি মামলায় ৯৮ হাজার ১৩৭ জনকে আসামি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ২৫ হাজার ৩৩ জন রাজনৈতিক নেতা, অর্থাৎ একটি মামলায় গড়ে ২১ জন রাজনৈতিক নেতাসহ ৮৪ জন আসামি। এ ধরনের গণহারে করা মামলা এটাই বোঝায় যে অপরাধের সঙ্গে যুক্ত নন, এমন অনেক ব্যক্তি হয় গ্রেপ্তার হয়েছেন অথবা তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর গুরুতর সহিংসতার জন্য অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার ক্ষেত্রে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। তারা বলেছে, বিচারপ্রক্রিয়া নিরপেক্ষ ও তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে পরিচালিত হতে হবে। অপরাধীদের রাজনৈতিক পরিচয় বা অন্য কোনো বাহ্যিক প্রভাব যেন বিচারের পথে বাধা সৃষ্টি না করে।

অন্তর্বর্তী সরকারকে আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মী, পুলিশ, ধর্মীয় ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ওপর সংঘটিত অপরাধের দ্রুত ও স্বাধীন তদন্ত নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, এসব ঘটনায় জড়িত অপরাধীদের মধ্যে যাদের পরিচয় জানা গেছে, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিচারহীনতা ও প্রতিশোধের চক্র থেকে মুক্তির জন্য জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *