গণ অভ্যুথানে গুলিবিদ্ধ স্বামীকে বাঁচাতে ৩ দিনের সন্তানকে বিক্রি করলেন মা

দিনাজপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ এক দিনমজুরের চিকিৎসা করানোর জন্য নবজাতক সন্তানকে বিক্রি করেছেন তার স্ত্রী। ঘটনাটি ঘটেছে দিনাজপুর সদর উপজেলার রাজবাড়ী এলাকায়। ওই দিন মজুরের নাম আব্দুর রশিদ। ৫ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে দিনাজপুর ২৫০ শয্যা হাসপাতালেই ভর্তি হন।কিন্তু হামলা-মামলার ভয়ে স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি চলে যান রশিদ। পরে বেশি অসুস্থ হলে আবারও হাসপাতালে ফিরে আসেন। হাসপাতালের চিকিৎসা মেটানোর জন্য নিজের নবজাতক বিক্রি করে দেন। 

স্থানীয়রা জানায়, গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে দিনাজপুর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে চেকআপের জন্য নিয়ে যান আবদুর রশিদ।হাসপাতালের বহির্বিভাগের সামনে টিকিট নেওয়ার আগেই আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে ছোড়া শটগানের গুলি এসে লাগে তার গায়ে। হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর স্ত্রীকে নিয়ে ফিরে আসেন শহরের রাজবাড়ী এলাকায়। যে বাড়িটিতে তারা আশ্রিত হিসেবে থাকেন সেখানে। কিন্তু ৮ আগস্ট আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন তলপেটে গুলিবিদ্ধ রশিদ।

এদিকে প্রসবের সময় ঘনিয়ে আসায় রোকেয়ার অবস্থাও খুব একটা ভালো না। ওই দিন প্রতিবেশীরা তাৎক্ষণিক চাঁদা তুলে রশিদকে দিনাজপুরের এম আবদুর রহিম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করান। পরদিন ৯ আগস্ট অস্ত্রোপচার হয় তার। একই দিনে ফুটফুটে এক কন্যাসন্তানের জন্ম দেন রোকেয়া। ওই কন্যাসন্তানের মুখ আর দেখা হয়নি রশিদের।তারই চিকিৎসার খরচ জোগাতে মাত্র ৭২ ঘণ্টা (তিন দিন) বয়সের সন্তানকে বিক্রি করে দিয়েছেন রোকেয়া। নির্মম এই সত্যকে মেনেও নিয়েছেন তারা। তবে সরকারের তরফ থেকে গণ-অভ্যুত্থান ঘিরে আহতদের সব ধরনের চিকিৎসা ব্যয় বহন করার কথা বলা হলেও রশিদের ক্ষেত্রে সেটি হয়নি। 

তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দিনাজপুরের নেতারা কাছে রশিদসহ অন্য আহতদের তালিকা রয়েছে। তালিকা ধরে তাদের খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। সাধ্যমতো সহায়তাও করা হচ্ছে। এ কথা বলেছে জেলার সদর উপজেলা প্রশাসনও। 

হাসপাতাল কর্তৃপক জানায়, সে সময় একই ধরনের অনেক রোগীর চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ ও সরঞ্জামের সরবরাহ পর্যাপ্ত ছিল না। সে কারণে অনেক ওষুধ সব রোগীকেই বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে।

এদিকে রশিদ-রোকেয়ার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ হয়, তখন সন্তানকে ফিরে পাওয়ার তেমন ইচ্ছে প্রকাশ করেনি তারা।

বুকে কষ্ট চেপে রেখে রোকেয়া বেগম বলেন, ‘৪ আগস্ট আন্দোলনে আমার স্বামীর গায়ে গুলি লাগে। পরে হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে আমার স্বামীর অপারেশন হয়। অপারেশনের পর আমার স্বামীর অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। এর মধ্যে আমার বাচ্চা হয়। সেই সময় হাতে টাকা ছিল না। স্বামীর চিকিৎসা করাতে হবে, তাই তিন দিনের বাচ্চাকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিই। সেই টাকা দিয়ে স্বামীর চিকিৎসা করছি। খারাপ তো লাগবে। কিন্তু সেই সময় কোনো উপায় ছিল না। স্বামীকে তো বাঁচাতে হবে।’

তিনি বলতে চেষ্টা করেন, ‘পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তার স্বামী। তার একটা অপারেশন হয়েছে। আরো অপারেশন লাগবে। সুস্থ হতে তার আরো এক-দুই বছর সময় লাগতে পারে। আর পুরো সুস্থ না হওয়ারও ঝুঁকি আছে। তিনি সুস্থ না হয়ে উঠলে যে সন্তান এখন কাছে রয়েছে তাকে নিয়েই পথে বসতে হবে। সে কারণেই ছোট্ট সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বরং সে এখন যাদের পরিবারে গেছে, সেখানেই ভালো থাকবে। আমরাও হয়তো ভালো থাকব!।’

গুলিবিদ্ধ আহত আবদুর রশিদ বলেন, ‘দিনমজুর মানুষ, অপারেশনে অনেক টাকার প্রয়োজন হওয়ায় স্ত্রী একজনের কাছে শিশুসন্তানকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে। এক সস্তানের জন্য কষ্ট হলেও আরেক সন্তান ও স্ত্রীর ভবিষ্যৎ চিন্তা করে তা মেনে নিয়েছি।’

রশিদের প্রতিবেশীরা জানায়, রশিদ-রোকেয়া দম্পতির নিজের কোনো জায়গাজমি নেই। অন্যের বাড়িতে আশ্রিত হিসেবে থাকেন তারা। 

স্থানীয়রা জানায়, ইতিমধ্যে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে রশিদকে আর্থিক সহযোগিতা করা হয়েছে। 

ওয়ার্ড জামায়াতের আমির আবদুর রহিম জানান, ভবিষ্যতেও তারা রশিদের পাশে থাকবেন।

দিনাজপুর এম আবদুর রহিম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. এ টি এম নুরুজ্জামান বলেন, ‘এখন পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত ১৮২ জনের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকজনের অপারেশন করা হয়েছে এবং কয়েকজন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। একসঙ্গে একই ধরনের অনেক রোগীর চিকিৎসাসেবা দিতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়েছে। অনেক ধরনের ওষুধ ও সরঞ্জাম হাসপাতালে সরবরাহ ছিল না। সেগুলো অনেক রোগীকেই বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘চিকিৎসা নিয়ে যাওয়াদের মধ্যে এখনো যাদের শারীরিক সমস্যা হচ্ছে, তাদেরও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।’ 

দিনাজপুরের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আবির হোসেন বলেন, ‘আমরা রশিদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। বিক্রি করা শিশুটিকে তারা ফিরিয়ে এনে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু রশিদ-রোকেয়ার আর্থিক অবস্থা এখন এতটাই করুণ যে, একটা বাড়তি মুখে ঠিকঠাক খাবার তুলে দেওয়া বা যত্ন নেওয়ার সামর্থ্য তাদের নেই। তাই হয়তো সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। আমরা তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করব।’

দিনাজপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফয়সাল রায়হান বলেন, ‘আন্দোলনে আহতদের মধ্যে যাদের তথ্য আমাদের কাছে কাছে, আমরা তাদের নানাভাবে সহায়তার চেষ্টা করছি। আমরা রশিদ ও তার পরিবারের পাশে থাকব। যত দ্রুত সম্ভব তাদের আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘর দেওয়ার চেষ্টা করছি। প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বলব।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *