ছাত্রলীগ এখন ‘সন্ত্রাসী সত্তা’: এর মানে কী, আইন কী বলে

গত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে হত্যা, নির্যাতন, গণরুমকেন্দ্রিক নিপীড়ন, ছাত্রাবাসে সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নসহ নানা ধরনের জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ডে জড়িত বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে ‘সন্ত্রাসী সত্তা’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

সরকারের নির্বাহী আদেশে সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইন।

এ আইনের ১৮ ধারায় বলা হয়েছে, “এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, সরকার, কোনো ব্যক্তি বা সত্তা সন্ত্রাসী কার্যের সহিত জড়িত রহিয়াছে মর্মে যুক্তিসঙ্গত কারণের ভিত্তিতে, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, উক্ত ব্যক্তিকে তফসিলে তালিকাভুক্ত করিতে পারিবে বা সত্তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা ও তফসিলে তালিকাভুক্ত করিতে পারিবে।”

সরকার চাইলে সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে, যে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনকে তফসিলে তালিকাভুক্ত করতে বা তফসিল থেকে বাদ দিতে পারবে বা অন্য কোনোভাবে তফসিল সংশোধনও করতে পারবে।

জরুরি অবস্থার মধ্যে ২০০৮ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি অধ্যাদেশ জারি করে, যা ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন’ হিসেবে সংসদে পাস হয়।

আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছরে জঙ্গি সংস্লিষ্টতার অভিযোগে বিভিন্ন সময়ে দশটি দলকে নিষিদ্ধ করলেও ক্ষমতা হারানোর ঠিক আগে মুহূর্তে ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন’ প্রয়োগ করে প্রথম রাজনৈতিক দল হিসাবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

সন্ত্রাসবিরোধী আইন 2009 এর আওতায় সন্ত্রাসী কারা?

সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ‘সন্ত্রাসী কাজের’ সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি, সত্তা বা বিদেশী নাগরিক বাংলাদেশের অখণ্ডতা, সংহতি, জননিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার জন্য জনসাধারণ বা জনসাধারণের কোনো অংশের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে সরকার বা কোন সত্তা বা কোনো ব্যক্তিকে কোনো কাজ করতে বা করা থেকে বিরত রাখতে বাধ্য করার জন্য অন্য কোনো ব্যক্তিকে হত্যা, গুরুতর আঘাত, আটক বা অপহরণ করে বা করার চেষ্টা করে, এ ধরনের কাজের জন্য অন্য কারো সঙ্গে ষড়যন্ত্র বা সহায়তা বা প্ররোচিত করে; অথবা অন্য কোনো ব্যক্তি, সত্তা বা প্রজাতন্ত্রের কোনো সম্পত্তির ক্ষতি করে বা করার চেষ্টা করে; অথবা ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্র বা সহায়তা বা প্ররোচিত করে; অথবা এ ধরনের উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো বিস্ফোরক দ্রব্য, দাহ্য পদার্থ ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে বা নিজ দখলে রাখে, কোনো সশস্ত্র সংঘাতময় দ্বন্দ্বের বৈরী পরিস্থিতিতে অংশ নেয়, তাহলে তা ‘সন্ত্রাসী কাজ’ বলে গণ্য হবে।

আইনের ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি সন্ত্রাসী কাজ করলে, সন্ত্রাসী কাজে অংশ নিলে, সন্ত্রাসী কাজের জন্য প্রস্তুতি নিলে বা সন্ত্রাসী কাজ সংঘটনে সাহায্য বা উৎসাহ দিলে, সন্ত্রাসী কাজের সঙ্গে জড়িত কাউকে সমর্থন বা সহায়তা দিলে সেই ব্যক্তি, সত্তা বা সংগঠন সন্ত্রাসী কাজের সঙ্গে জড়িত বলে বিবেচিত হবে।

‘সত্তা’ বলতে কোনো আইনি প্রতিষ্ঠান, সংবিধিবদ্ধ সংস্থা, বাণিজ্যক বা অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, গোষ্ঠী, অংশীদারী কারবার, সমবায় সমিতিসহ এক বা একাধিক ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত যে কোনো সংগঠনকে বোঝানো হয়েছে।

সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৭(ঙ) ধারায় বলা হয়েছে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের রেজুলেশন নম্বর ১৯৭৩ অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি বা সত্তা কোনো সন্ত্রাসী কাজ করে বা চেষ্টা চালায় বা অংশ নেয় বা সন্ত্রাসী কাজে সহযোগিতা করে, তাহলে সে নিষিদ্ধের মানদণ্ডের আওতাভুক্ত হবে।

এছাড়া তালিকাভুক্ত বা নিষিদ্ধ ঘোষিত যে কোনো ব্যক্তি বা সত্তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মালিকাধীন বা নিয়ন্ত্রণাধীন কোনো সত্তা বা তালিকাভুক্ত বা নিষিদ্ধ ঘোষিত যে কোনো ব্যক্তি বা সত্তার পক্ষে বা নির্দেশে কাজ করে এমন কোনো ব্যক্তি বা সত্তা নিষিদ্ধের আওতাভুক্ত হবে।

এমনকি কোনো সন্ত্রাসী ব্যক্তিকে আশ্রয় দিলে বা অন্য কোনভাবে সন্ত্রাসী কাজের সাথে জড়িত হলেও সেই ব্যক্তি বা স্বত্ত্বা সন্ত্রাসী কাজের সঙ্গে জড়িত বলে গণ্য হবে।

শাস্তি কী?

সন্ত্রাস দমন আইনে কোনো অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড এবং অন্যূন ৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।

আইনজীবী তুরিন আফরোজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দোষী প্রমাণিত হলে অপরাধের গুরুত্ব অনুসারে এই আইনের আলোকে শাস্তি দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে।

“কেউ যদি কাউকে মেরে ফেলে বোমা ছুড়ে, তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ছাড়া কী হবে? আর যদি সে আরও কম গুরুতর কোনো অপরাধ করে, তাহলে শাস্তি কম হবে।”

আইনের ৬ নম্বর ধারায় শাস্তির বিষয়ে বলা হয়েছে-

  • যদি কোনো ব্যক্তি, সত্তা বা বিদেশী নাগরিক অন্য কোনো ব্যক্তিকে হত্যা, গুরুতর আঘাত, আটক বা অপহরণ করে বা করার চেষ্টা করে, তাহলে তিনি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন বা এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ড আরোপ করা যাবে।
  • এ ধরনের কাজের জন্য অন্য কোন ব্যক্তিকে ষড়যন্ত্র বা সহায়তা বা প্ররোচিত করে, তাহলে এই অপরাধের নির্ধারিত শাস্তি যদি মৃত্যুদণ্ড হয়, সেক্ষেত্রে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ১৪ বছর ও অন্যূন ৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
  • যদি কোনো ব্যক্তি, সত্তা বা বিদেশী নাগরিক অন্য কোনো ব্যক্তি, সত্তা বা প্রজাতন্ত্রের কোন সম্পত্তির ক্ষতি করে বা করার চেষ্টা করে, তাহলে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ১৪ বছর ও অন্যূন ৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
  • যদি কোনো ব্যক্তি বা সত্তা প্রজতিন্ত্রের কোনো সম্পত্তির ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্র বা সহায়তা বা প্ররোচিত করে, তাহলে তিনি অনূর্ধ্ব ১৪ বছর ও অন্যূন ৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
  • কোনো ব্যক্তি বা সত্তা এ ধরনের উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো বিস্ফোরক দ্রব্য, দাহ্য পদার্থ ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে বা নিজের দখলে রাখে, তাহলে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ১৪ বছর ও অন্যূন ৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
  • যদি কোনো সত্তা সন্ত্রাসী কার্য সংঘটন করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে ১৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাবে এবং এর অতিরিক্ত অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির মূল্যের তিনগুণ পরিমাণ অর্থ বা ৫০ লাখ টাকা বা এর বেশি অর্থদণ্ড আরোপ করা যাবে।
  • ওই সত্তার প্রধান, তিনি চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রধান নির্বাহী বা অন্য যে কোন নামে অভিহিত কেউ অনূর্ধ্ব ২০ বছর ও অন্যূন ৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং এর অতিরিক্ত অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত সম্পত্তির মূল্যের দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ বা ২০ লাখ টাকা বা এর বেশি অর্থদণ্ড আরোপ করা যাবে, যদি না তিনি প্রমাণ করতে সমর্থ হন যে, এই অপরাধ তার অজ্ঞাতসারে সংঘটিত হয়েছিল বা এটি সংঘটন নিবৃত্ত করার জন্য তিনি সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *