ছাত্র-জনতার আন্দোলন: মিলছে না সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মরদেহের হিসাব

বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে হতাহতদের বড় একটি অংশকে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলেও হাসপাতালটিতে মাত্র ৪৯ জনের মৃত্যু রেকর্ডভুক্ত করা হয়েছে , যা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন জুলাই ও আগস্টে দায়িত্ব পালন করা কর্তব্যরত চিকিৎসকরাও।

সেসময়ের কর্তব্যরত চিকিৎসকদের সাথে কথা বলে জানা যায় , সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি হতাহত আসতে শুরু করে ১৮ জুলাই থেকে। ওই এক দিনেই শতাধিক ব্যক্তিকে মৃত ও আহত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। আহতদের অনেকেই পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। আর পরদিন ১৯ জুলাই মৃত অবস্থায় আনা হয় ৩৩ জনকে। আহত অবস্থায় যাদের আনা হয়, তাদের মধ্যে ভর্তি অবস্থায় মারা যান আরো ২৫-৩০ জন। এরপর ২০ জুলাই ও চলতে থাকে একই অবস্থা। ওই দিন মারা যান ৫০ থেকে ৬০ জন। তবে ২১শে জুলাইয়ের পর থেকে কমে যায় মৃতের সংখ্যা। আবার ১ থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত হাসপাতালে ১০-১৫ জনের মরদেহ নিয়ে আসা হয়।

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আসা হতাহতদের সংখ্যা বের করতে একটি কমিটি গঠন করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ওই কমিটির প্রধান ছিলেন ওয়ান স্টপ ইমার্জেন্সি সার্ভিসের (ওসেক) ইনচার্জ ডা. ফয়েজুর আহসান ইমরান। কমিটি ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪৯টি মরদেহের একটি তালিকা করে। তবে সেই তালিকায় সর্বসাধারণের জন্য প্রকাশ করা হয়নি। এমনটি সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. শফিউর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন , ‘মরদেহের সংখ্যা আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। সুতরাং এটা আর ডিসক্লোজ করার দরকার নেই।’

আর এবিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক ডা. ফয়েজুর আহসান ইমরান বলেন, ‘সেই সময় অনেক বেশি হতাহত ছিল। ফলে অনেকের রেজিস্ট্রেশন করা সম্ভব হয়নি। এদিকে হাসপাতালের মর্গে জায়গা না হওয়ায় ইমার্জেন্সিতে কিছু মরদেহ রাখা হয়েছিল। সেখান থেকে স্বজনরা কিছু মরদেহ নিয়ে যায়। যদিও পরে তাদের অনেকেই আমাদের কাছে তথ্য দিয়ে গেছে। সব মিলিয়ে ৪৯ জনের মৃত্যুর তথ্য আমরা পেয়েছি।’

এবিষয়ে হাসপাতালের অন্য চিকিৎসকরা জানান, আওয়ামীলীগ সমর্থিত স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের চিকিৎসকদের একটি দলকে পরিচালকের নির্দেশে জরুরি বিভাগে দায়িত্ব দেয়া হয়। দায়িত্বের সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেক গুরুতর আহত এবং মুমূর্ষু রোগীকে রিলিজ দিয়েছেন। অনেক গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিকেও প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন, যেন গণমাধ্যমে আহতের সংখ্যা কম আসে। হতাহতের সঠিক সংখ্যা বের করতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানান তারা।

এদিকে আইনজ্ঞরা বলছেন, ফৌজদারি কার্যবিধি পুলিশের প্রবিধান অনুযায়ী, কোনো থানা এলাকায় কোনো ব্যক্তির অস্বাভাবিক মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ামাত্র পুলিশ লাশ দেখতে যাবেন। এরপর মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করবেন। মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে মরদেহ পাঠাতে হবে ফরেনসিক চিকিৎসকের কাছে। ফরেনসিক চিকিৎসক ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করবেন। সেই প্রতিবেদনে মৃত্যুর কারণ লিপিবদ্ধ করবেন। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন খুনের মামলার অন্যতম সাক্ষ্য। আর গুলিবিদ্ধ মৃতদেহের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ছাড়া লাশ হস্তান্তর করা আইনসিদ্ধ নয়। আইন অনুযায়ী কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘাত ও সংঘর্ষে ছাত্র, জনতা ও পুলিশের যেসব সদস্য মারা গেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন করা উচিত ছিল। কারণ, কোনো ব্যক্তির অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত করতে হবে। ময়নাতদন্ত না হলে ওই ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ জানা যাবে না।

এবিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধি লঙ্ঘনের দায়ে জড়িত সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে দ্রুত প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। এসব খুনের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে হলে প্রতিটি মরদেহের ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা করতে হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *