ড. ইউনূস দৃষ্টিকটুভাবে ক্রমাগত ছাত্রদের মহিমান্বিত করে যাচ্ছেন। এসব মহিমান্বিত করার প্রচেষ্টা খুবই সমস্যাপ্রবণ। কারণ আমরা দেখেছি, মুক্তিযুদ্ধ এবং শেখ মুজিবকে মহিমান্বিত করার মধ্য দিয়ে কিভাবে জাতিকে ১৫ বছর গোলামীর শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকতে হয়েছে। আর আমারা তাৎক্ষণিকভাবে দেখতে পাচ্ছি ছাত্রদের এই গ্লোরিফাই করা কিভাবে ক্যাম্পাসে এবং সারাদেশে মব জাস্টিস উস্কে দিচ্ছে। যাতে প্রতিদিনই জানমাল ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এবং আওয়ামী লীগের কিছু কর্মী নিহত হওয়ার ঘটনায় বিগত ১৫ বছর নির্মমতা চালানো এই দলটিকে এক প্রকার পুনর্বাসনের উপলক্ষ্য তৈরী করে দেয়া হচ্ছে।
ড.ইউনূস তার প্রতিটি বক্তৃতায় শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত প্রশংসা করছেন এবং তাদেরকে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের একমাত্র কারণ হিসেবে উল্লেখ করছেন। কিন্তু, মুহাম্মদ ইউনূস এর বয়ানের কারণে যে ন্যারেটিভ তৈরি হচ্ছে তা মৌলিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ। কারণ তার প্রদত্ত ন্যারেটিভে সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগ উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে, কিন্তু আদতে ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের ভিত্তিতে মূল আঘাতটি করে তাঁরাই। আর এটা দিবালোকের মতোই স্পষ্ট যে শুধুমাত্র ছাত্ররা স্বৈরশাসককে ক্ষমতাচ্যুত করেনি। বরং কোটা সংস্কারের দাবিতে মাঠে নামা বিপন্ন ছাত্রদের পশে সকল শ্রেনী-পেশার সাধারণ মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়েছিল, মানব বর্ম হয়ে ছাত্রদের সামনে তাঁরা ঢাল হিসেবে হিসবে দাঁড়িয়ে কছিলেন, রুখে দিয়েছেন রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বর্বরতা।
প্রকৃতপক্ষে, এই আন্দোলনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের চেয়ে বেশি সাধারণ মানুষ মারা গেছে। ছাত্রদের উপর চলা প্রথম তিন দিনের বর্বরতা জাতিকে এতটাই ক্ষুব্ধ করেছিল যে, ১৮ জুলাইয়ের পরে এই আন্দোলনের অগ্র সৈনিকে পরিণত হয় সাধারণ নাগরিকরা – যারা মূলত দরিদ্র খেকে মধ্যবিত্ত শ্রেনীর, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার ছাত্ররা। তারাই বিক্ষোভকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সাধারণ মানুষের অংশ গ্রহণ নগণ্য করে দেয় ছাত্রদের অংশগ্রহণ। ধীরে ধীরে এই সাধারণ মানুষ আন্দোলনের পতাকাবাহী হয়ে ওঠে এবং কোটা থেকে এটিকে গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত করেন।
এই অবিস্মরণীয় ঘটনায় দেশের আপামর জনসাধারণ আকাশছোঁয়া মুদ্রাস্ফীতি, ধুঁকতে থাকা অর্থনীতি, দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতি, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, ভোটের অধিকার, বাক-স্বাধীনতা আদায়ে বদ্ধপরিকর জনগন স্বয়ংক্রিয় রাইফেল পরোয়া না করে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায় নিজ ছাতি মেলে ধরেন, ছাত্রদের রক্ষা করতে গিয়ে অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান, আহত হন অসংখ্য।
শেখ হাসিনার পদত্যাগের জন্য ছাত্ররা তাদের এক দফা দাবি ঘোষণা করার আগে, নাগরিকেরাই প্রথম সেই আহ্বান জানিয়েছিলেন। ২,৩ এবং ৪ আগস্টের শতাধিক ছবি এবং ভিডিওতে দেখা যায় সাধারণ মানুষ এবং সমাজ প্রতিনিধিগণ প্রথম হাসিনার পদত্যাগ দাবি করছেন। যা ছাত্রদের ৯ ও ১৫ দফাকে ১ দফায় রুপান্তরিত করতে বাধ্য করে। বিএনপি ও জামায়াত সমর্থকদের অংশগ্রহণ ছাড়া — যারা ৪ ও ৫ আগস্ট রাজপথের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল এবং অসংখ্য হতাহতের শিকারও হয়েছিল — স্বৈরশাসককে অপসারণ করা ছিলো অসম্ভব।
ড. ইউনূসের একতরফা শিক্ষার্থীদের কৃতিত্ব দেয়া জাতির জন্যও বড় ঝুঁকি তৈরী করে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ ইতোমধ্যেই মব জাস্টিস, ছাত্রদের অসদাচরণ ও আইন শৃঙ্খলার অবনতির করণে বেশ হতাশ-মনক্ষুন্ন। তাদের এতো আত্মত্যাগের পরও কিছু মুষ্টিমেয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের রাজনৈতিক দৃশ্যে আধিপত্য বিস্তার করায় তারা প্রবল বঞ্চিত বোধ করছেন। বৈষম্য বিরোধীরা কি তাহলে নিজেরাই অন্যদের উপর বৈষম্য চাপিয়ে দেবে?
আন্দোলনে নেপথ্য নায়ক সেই সব দরিদ্র এবং মধ্যবিত্ত জনতা—যারা তাঁদের জীবন দিয়ে ঘাতক সরকারকে হটিয়ে দিয়েছিল— তাঁরা তাদের জীবনে কোনো পরিবর্তন খুঁজে পাচ্ছে না এবং তাঁরা যে প্রতারিত হচ্ছেন এমনটা অনুভব করছেন। সবচাইতে পরিতাপের বিষয় গরিব-বান্ধব কার্যকলাপের জন্য তার খ্যাতি অর্জন করা ড. ইউনূস ছাত্রদের আশা-আকাঙ্খাকে বাস্তবায়িত করতে গিয়ে ওই মানুষগুলোকে যেন আর গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
গরীবরা তাকে খ্যাতি এনে দেওয়ায় তিনি বিশ্বব্যাপী গরীবদের হাইলাইট করেছেন, বিশ্বে পরিচিত হয়েছেন গরীবের ব্যাংকার নামে। এখন ছাত্ররা তাকে ক্ষমতায় বসানোয় যদি তিনি কেবল মুষ্টিমেয় তাদেরকেই গুরুত্বদেন তাহলে তা বেশ দু:খ জনক হবে।আর এই ন্যারেটিভ শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবনে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিরও কারণ হয়ে দাঁড়াবে। অনেকে তাঁদের পড়াশোনা এবং আগের জীবনযাত্রায় ফিরে আসতে সংগ্রাম করছেন কারণ তারা “রাষ্ট্র মেরামত” এর সাথে অতিরিক্তভাবে জড়িত।
সব কিছুতেই ২০+ বয়সী তরুণ-তরুণীদের কাছে বাংলাদেশের সমস্ত সমস্যার জন্য একটি নিরাময় আছে এটা এক ভ্রান্ত ধারণা – এবং শুধুমাত্র তাদের মতামতই বৈধ — এটাও চরম হঠকারিতা। ছাত্ররা অবশ্যই দেশ পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। তবে জাতি গঠনের মূল কাজটি অভিজ্ঞ ও দক্ষ ব্যক্তিদের উপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত। যারা আগের শাসনামলের সুবিধাভোগী ছিলেন তাদের চিহ্নিত করতে হবে এবং দেশ গঠনে কিছুতেই তাদের যুক্ত করা যাবেনা।
মোরাল পুলিশিং ছাত্রদের অসহিষ্ণুতার দিকে ধাবিত করছে, স্বাধীন মতপ্রকাশকে রুদ্ধ করার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ক্ষুন্ন করে, মব জাস্টিস মানসিকতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং প্রায়ই ক্ষমতার অপব্যবহারের দিকে নিয়ে যায়। দীর্ঘমেয়াদে, এই ধরনের আচরণ সামাজিক সৌহার্দ্য ব্যাহত করে, দেশ এবং ক্যাম্পাসে ভীতি ও বিভাজন সৃষ্টি করে।
জনাব ইউনূসকে এ সকলের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে – তাকে সমাজের একটি অংশ নয়, সবার নেতা – অভিভাবক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ছাত্রদের উপর তার অত্যধিক নির্ভরশীলতা এবং দুর্বলতা তার এই রুপান্তরে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে।
জনগণের শক্তিকে উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা সম্পূর্ণভাবে প্রশাসন, পুলিশ ও নিরাপত্তা সংস্থার ওপর নির্ভর করেছিলেন। শিক্ষার্থীদের উপর একই মাত্রায় নির্ভর করে ইউনূসও এখন সে ধরনের ভুল করার ঝুঁকি নিচ্ছেন। ড. ইউনূসকে দ্রুত সাধারণ মানুষের নেতা হিসাবে দাঁড়াতে দেখতে চাই। তিনি কোন গোষ্ঠির পাপেটে পরিণত হন — এবং আমরা ওই স্কয়ার ওয়ানে ফিরে যাই, সেটা কিছুতেই চাইনা।
জুলকারনাইন সায়ের এর ফেসবুক থেকে সংগ্রহীত