নতুন পাঠ্যবইয়ে ফিরছেন জিয়াউর রহমান-খালেদা জিয়া

ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামলে সব জায়গায় ছিল মুজিব আর হাসিনার বন্দনা। সেই বন্দনা কার্যক্রম থেকে ব্যাড যায়নি পাঠ্যপুস্তকও। প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সব পাঠ্যবইতেই ছিল মুজিব আর হাসিনার স্তুতি। পাঠ্যপুস্তক থেকে একেবারে মুছে ফেলা হয় স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া , মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, জেনারেল মুহম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর মতো অসংখ গুণীজনের নাম। মুক্তিযুদ্ধ-ভাষা আন্দোলনে অবদান রাখা অনেক বীর ছিলেন সেখানে অপাঙক্তেয়। তবে পাঠ্যবই সংশোধনের মধ্যদিয়ে জাতি গঠনে যার যেটুকু সবার অবদান, তা নির্মোহভাবে তুলে ধরতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার।

আর সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সব পাঠ্যবই সংশোধন ও পরিমার্জন করা হচ্ছে। সেখানে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে যুক্ত হচ্ছে জিয়াউর রহমানের নাম। আর ‘রাজনীতিতে নারী’ শীর্ষক প্রবন্ধে যুক্ত হচ্ছে খালেদা জিয়ার নাম।

স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই পাঠ্যবইয়ে সংশোধন আনা হয়। সব শ্রেণির বইয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের সব অংশেই সামগ্রিকভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান দেখানো হয়। বাদ দেওয়া হয় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানের নাম। তবে এবার স্বাধীনতার একক ঘোষক হিসেবে জিয়াউর রহমানের নাম যুক্ত হতে যাচ্ছে পাঠ্যপুস্তকে।

এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রবন্ধগুলোতে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। একাত্তরের ইতিহাসের নায়ক হিসেব শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, তাজউদ্দিন আহমেদ, মওলানা ভাসানী, জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীর অবদান স্থান পাচ্ছে।

২৬ মার্চ জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার যে ঘোষণা দেন, সেটি যুক্ত করা হচ্ছে। আর ২৭ মার্চ জিয়াউর রহমান শেখ মুজিবুর রহমানে আদিষ্ট হয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বলেও উল্লেখ করা হচ্ছে।

পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন কমিটির একজন সদস্য বলেন, ‘এক চোখে দেখা ইতিহাস আমরা রাখছি না। সত্য, সঠিক ও জনগণের চোখে চোখে যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে যার যতটুকু অবদান সেটা তুলে ধরা হবে। কোনো পক্ষের প্রতি আমাদের অনুকম্পা নেই। কারও প্রতি বিদ্বেষও নেই।’

ফিরছে খালেদা জিয়ার নাম
ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারী’ প্রবন্ধে এতদিন শেখ হাসিনা, সাবেক স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর নাম ও তাদের কর্মজীবন তুলে ধরা হয়েছিল। কোনো কোনো বইয়ে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির নামও ছিল। কিন্তু কোথাও তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নাম রাখা হয়নি।

পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনে গঠিত বর্তমান কমিটির সদস্যরা সেখানে খালেদা জিয়ার নাম যুক্ত করছেন। খালেদা জিয়ার পাশাপাশি শেখ হাসিনা ও শিরীন শারমিন চৌধুরীসহ আরও বেশ কয়েকজন নারীর নাম রাখা হবে।

বাদ পড়ছে জাফর ইকবালের সব গল্প-প্রবন্ধ
আওয়ামী লীগের শাসনামলে পাঠ্যবই রচনা ও সম্পাদনায় একচেটিয়া প্রভাব ছিল দলটির অনুসারী বলে পরিচিত জুলাই – আগস্ট গণআন্দোলনের সময় ব্যাপকভাবে সমালোচিত অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবালের। বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে তার একাধিক গল্প-প্রবন্ধ ছিল। তাছাড়া অনেক বইয়ের সম্পাদনার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। তার লেখা গল্প-প্রবন্ধ বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনসিটিবি। পাশাপাশি সম্পাদনায় যুক্ত হিসেবে বইয়ে থাকা তার নামও বাদ দেওয়া হবে।

জানা গেছে, একাদশ শ্রেণির বাংলা বইয়ে অধ্যাপক জাফর ইকবালের ‘মহাজাগতিক কিউরেটর’ শিরোনামে একটি লেখা ছিল। সেটি বাদ দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণির বিজ্ঞান বিষয়ের সব বই থেকেও জাফর ইকবাল লেখাগুলো পুরোপুরি বাদ পড়ছে।

ব্যাড পড়ছে শেখ মুজুবের লেখা ‘বায়ান্নের দিনগুলো’
একাদশ শ্রেণির বাংলা বইয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ‘বায়ান্নের দিনগুলো’ গল্পটি বাদ দেওয়া হয়েছে। এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলছেন, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর চেয়ে অনেকের অবদান ছিল অনেক বেশি। এ গল্পে তাদের সেই অবদানের কথা বাদ পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়। গল্পটি পড়লে শিক্ষার্থীরা ভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস জানতে পারবে না। সেই বিবেচনায় লেখাটি বাদ দেওয়া হয়েছে। সেখানে ভাষা আন্দোলন নিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি গল্প যুক্ত করা হবে।

তবে ‘বায়ান্নের দিনগুলো’ গল্পটি বাদ গেলেও ইংরেজি বইয়ে তার ৭ মার্চের ভাষণ থাকছে। তবে সেখানেও অতিরঞ্জন কমানো হয়েছে। একই সঙ্গে একই অধ্যায়ে মার্টিন লুথার কিং ও নেলসন মেন্ডেলার বিখ্যাত ভাষণও যুক্ত করা হচ্ছে।

হাসিনার ছবি বাদ, বইয়ের মলাটে গ্রাফিতি
আওয়ামী লীগের আমলে পাঠ্যবইয়ের পেছনে শেখ হাসিনার ছবি এবং সঙ্গে তার একটি করে বাণী যুক্ত করা হয়েছিল। এবার বই পরিমার্জন ও সংশোধনে তা বাদ দেওয়া হচ্ছে। নতুন পাঠ্যবইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে রাখা হবে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান ঘিরে শিক্ষার্থীদের আঁকা বিভিন্ন গ্রাফিতি।

সব শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি ও বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বইয়ের পেছনে বিভিন্ন গ্রাফিতি যুক্ত হবে। সেগুলো বর্তমানে বাছাইয়ের কাজ চলছে। অন্যদিকে ইসলাম ধর্ম বইয়ের পেছনে আরবি ক্যালিগ্রাফির গ্রাফিতি যুক্ত করা হবে। তাছাড়া মাদরাসার বিশেষায়িত বইগুলোর পেছনেও আরবি ক্যালিগ্রাফি থাকবে।

যুক্ত হচ্ছে শহীদ আবু সাঈদ-মুগ্ধর জীবনী ও ত্যাগ নিয়ে প্রবন্ধ

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের একেবারে শুরুতে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। একদিন পরই ঢাকায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মাঝে পানি বিতরণের সময় শহীদ হন মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ। তাদের মৃত্যু নৃশংস হত্যাকাণ্ড হিসেবে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। তাদের ত্যাগে বেগবান হয় আন্দোলনও।

সেজন্য পাঠ্যবইয়ে আবু সাঈদ ও মুগ্ধর জীবনী ও তাদের অবদান নিয়ে প্রবন্ধ যুক্ত করা হবে। যদিও ২০২৫ সালের বইতে এ বিষয়টি যুক্ত করা হবে কি না, তা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে তাদের নিয়ে প্রবন্ধ লেখার ব্যাপারে কমিটির সদস্যরা একমত। এবার না হলেও ২০২৬ সালের বইতে প্রবন্ধটি যুক্ত হতে পারে বলে জানিয়েছেন এনসিটিবির সম্পাদনা বিভাগের কর্মকর্তারা।

ভালো মানের বই পেতে আরও দুই বছরের অপেক্ষা

পাঠ্যবই পরিমার্জন সমন্বয় কমিটিতে রয়েছেন শিক্ষা গবেষক রাখাল রাহা। তিনি জানান, ‘কিছু পাঠ বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে এবার নতুন করে তেমন কোনো পাঠ যুক্ত করা সম্ভব হয়নি। হাতে সময়টা একদম কম। যেটুকু করা গেছে, সেটা হলো—অতিরঞ্জিত ইতিহাস ও মৌলিক কিছু পাঠে পরিমার্জন। আপাতত যেটুকু সম্ভব হয়েছে, আমরা করেছি। যদি ভালো মানের বই পাওয়ার কথা বলেন, তাহলে আরও দুই শিক্ষাবর্ষষ অপেক্ষা করতে হবে। যদি ইতিবাচকভাবে কাজটা হয়, তাহলে হয়তো তখন শিক্ষার্থীরা ভালো মানের পাঠসমৃদ্ধ বই পাবে।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *