নিত্যপণ্যের বাজারে ‘এক-এগারো সিনড্রোম’

বহুল আলোচিত এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে। দায়িত্ব গ্রহণের পরই সারা দেশে জোরদার করা হয় দুর্নীতিবিরোধী অভিযান। অভিযান থেকে রক্ষা পেতে গা ঢাকা দেন অনেক বড় ব্যবসায়ী। ব্যাহত হয় পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা। ওই বছর দেশে ঘটে যায় দুই দফা বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় সিডর। ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষি খাত। এসবের প্রভাবে অস্থির হয়ে ওঠে বাজার পরিস্থিতি। খাদ্য আমদানির উদ্যোগ নিয়েও পরিস্থিতি সামাল দেয়া যায়নি। ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে যায় মূল্যস্ফীতি। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি ওঠে প্রায় ১৭ শতাংশে। নিত্যপণ্যের দামের এমন উত্থানে সে সময় জনরোষ বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে নির্বাচন দিয়ে সরে যেতে বাধ্য হয় ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

দেড় দশকের মাথায় নিত্যপণ্যের বাজারে সে সময়কার পরিস্থিতিরই পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে। আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের দায়িত্ব নিয়েছে অধ্যাপক ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এ সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের ১২ দিনের মাথায় দেশের মধ্য-পূর্বাঞ্চলীয় ১১ জেলায় দেখা দেয় স্মরণকালের ভয়াবহ এক বন্যা। এতে শুধু কৃষি খাতেই ক্ষয়ক্ষতি হয় অন্তত ৫ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ক্ষয়ক্ষতির প্রায় ৩৬ শতাংশ। এ বন্যার প্রভাব কাটিয়ে না উঠতেই চলতি মাসের শুরুতে আবার বন্যাক্রান্ত হয় শেরপুর, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ ও জামালপুর। প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, এ বন্যায় শুধু কৃষি খাতেই ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার।

বর্তমানে দেশের নিত্যপণ্যের বাজারে দামের অস্থিতিশীলতা আরো জোরালো হয়ে উঠেছে। মোটা চালের দাম উঠেছে প্রতি কেজি ৬০ টাকার ওপরে। উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে সবজির বাজারও। প্রায় সব ধরনের সবজির দাম কেজিপ্রতি ১০০ টাকার আশপাশে। আটা, ডিম ও মুরগির বাজারেও দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। দাম বেড়েছে ইলিশের। সরকারি হিসাবে চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হওয়ার পরও নিয়ন্ত্রণের বাইরে ডিমের বাজার।

নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে সরবরাহ সংকট ছাপিয়ে এখন আলোচনায় আসছে বাজার ব্যবস্থাপনা ও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের বিষয়টি। বাজার নিয়ন্ত্রণে কিছু পণ্যে শুল্কছাড়সহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কিন্তু এর পরও বাজারে স্বস্তি ফিরছে না। নিত্যপণ্যের বাজারে মূল্য পরিস্থিতি স্বাভাবিকে ফেরানো নতুন সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিত্যপণ্যের বাজারের বর্তমান পরিস্থিতিকে এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কার পুনরাবৃত্তি হিসেবে দেখছেন বাজার পর্যবেক্ষকদের অনেকেই।

শুধু পণ্যের সরবরাহ সংকট নয়, অনিশ্চয়তাও বাজারকে অস্থির করে তোলে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক এক গবেষণা পরিচালক। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে তিনি বলেন, ‘অনিশ্চয়তা থাকলে বাজারে সরবরাহকারীরা ভিন্নভাবে আচরণ করে। তখন দাম বাড়ার এক ধরনের প্রত্যাশা থাকে। বন্যার প্রভাবে আগামীতে উৎপাদন কম হতে পারে, এমন চিন্তা থেকে চালের দাম বাড়ছে। তাছাড়া এখন ব্যাংকের বাইরে প্রচুর অর্থ মানুষের হাতে রয়েছে। এর প্রভাবও অতিরিক্ত টাকা ছাপানোর মতোই। এত অর্থ মানুষের হাতে থাকলে তা বাজার অস্থিরতায় ভূমিকা রাখতে পারে।’

২০০৭ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে পরপর দুই দফা বন্যা হয়। নভেম্বরে হানা দেয় সিডর। এতে মাঠে থাকা আমনের ব্যাপক ক্ষতি হয়। প্রায় ১০ লাখ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গণমাধ্যমে ওই সময় প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যমতে, দুর্যোগের প্রভাবে ২০০৭ সালের শুরুতে চালের গড় দাম ৩৩ টাকা কেজি থাকলেও ২০০৮ সালে তা ৪৫ টাকায় উঠে যায়। যদিও ২০০৯ সালে কিছুটা কমে ৪০ টাকা কেজিতে এসেছিল। তবে এবার উৎপাদন বেশি হওয়ায় এবং পর্যাপ্ত মজুদ থাকায় দাম বাড়ার কথা নয় বলে মনে করছেন কৃষি অর্থনীতিবিদরা। কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এবার চার কোটি টনের বেশি চাল উৎপাদন হয়েছে দেশে। ফলে চালের কোনো সংকট নেই। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে মজুদও রয়েছে যথেষ্ট। তাই দাম বাড়ার কথা নয়। কিন্তু সরবরাহকারী ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াচ্ছেন। এসব কারসাজির বিরুদ্ধে অভিযান চালানো দরকার। সরকার পরিবর্তন হলেও বাজার ব্যবস্থাপনায় কোনো পরিবর্তন আসেনি।’

দেশে নিত্যপণ্যের বাজারে এখন বড় সরবরাহকারীর তালিকায় আছেন অনেক ব্যক্তি উদ্যোক্তা। এসব ব্যক্তি ও অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিগত সরকারের নানা অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগে নানা বিধিনিষেধের মুখে পড়েছে। ফলে তাদের ব্যবসা কার্যক্রমও স্থবির হয়ে আসছে।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এনামুল হক বলেন, ‘সিন্ডিকেট ভাঙার সহজ পদ্ধতি হলো পণ্যের সংকট দেখা দিলে আমদানির অনুমতি দেয়া। তবে তাদেরকে ধরতে গেলে অস্থিরতা দেখা দেবে। গত তত্ত্বাবধায়ক আমলে ধরপাকড় শুরু হলে অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেন। এখনো এমনটা ঘটলে বাজারে আরো অস্থিরতা তৈরি হবে।’

এক-এগারো সরকারের সময় বন্যা-ঘূর্ণিঝড় এবং বাজার অব্যবস্থাপনায় জিনিসের দাম বাড়তে থাকায় মূল্যস্ফীতিও বেড়ে গিয়েছিল। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ থাকলেও পরবর্তী অর্থবছরে তা ১২ দশমিক ৩০ শতাংশে উন্নীত হয়। গত মাসেও দেশের সাধারণ মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১১ শতাংশের ওপরে।

অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারকরা বাজারে অস্থিতিশীলতার বড় একটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন সিন্ডিকেটকে। গতকালও ডিমের মূল্যবৃদ্ধির মূল কারণ ‘সিন্ডিকেট’ উল্লেখ করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন, এ নিয়ে কাজ করছে সরকার। বাজারে নিয়মিত অভিযান চলছে। এরই মধ্যে পাইকারিতে কিছুটা দাম কমছে। দ্রুতই দাম নাগালে আসবে।

সরকারের মনিটরিং ব্যবস্থা থেকে এখনো কার্যকর কোনো ফল পাওয়া যায়নি বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। বাজারে সিন্ডিকেট থাকলে কৃত্রিম সংকট থেকে জাতি মুক্তি পাবে না উল্লেখ করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারের বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা ভালো কাজ করছে না। সিন্ডিকেট ভাঙার কোনো প্রয়াস দেখতে পাইনি। আর শীতের আগে বাজারে স্বস্তি ফিরবে বলেও মনে হচ্ছে না।’

সরকার এরই মধ্যে বাজার নিয়ন্ত্রণে জেলায় জেলায় ডিসির নেতৃত্বে সমন্বিত কমিটি করে দিয়েছে। কিছু নিত্যপণ্যে শুল্কছাড়ের উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। আমদানির অনুমতিও দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এসবের প্রভাব বাজারে কমই পড়ছে। এরই মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত বাড়তে থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে। এর প্রভাব আগামীতে দেশের বাজারেও পড়তে পারে বলে আশঙ্কা বাজার পর্যবেক্ষকদের।

বাজার সংস্কারে নতুন সরকার এখনো কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি বলে মনে করছেন কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসেন। তিনি বলেন, ‘বাজার মনিটরিং চলছে ঢিমেতালে। অথচ এটাই প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত ছিল। সরকারের অন্যান্য সংস্কার কার্যক্রম ও কমিশনের মতো নিত্যপণ্যের বাজার সংস্কারেও একটি সুনির্দিষ্ট অবস্থান থাকা উচিত ছিল। মন্ত্রী পরিবর্তন হলেও আমলা একই আছে। তারা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিলে চক্রের মাধ্যমে বাজারে সিন্ডিকেট বজায় রেখেছে।’

চাল ও আটাসহ নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নতুন সচিব মো. মাসুদুল হাসান বলেন, ‘টিসিবির মাধ্যমে ১ কোটি পরিবার এবং ওএমএসের মাধ্যমে ৫০ হাজার পরিবারের মধ্যে সুলভ মূল্যে চাল ও আটা বিক্রি করা হচ্ছে। জেলায় জেলায় নতুন নীতিমালার আলোকে ওএমএস ডিলার নিয়োগ করা হচ্ছে। আগে রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ডিলারদের অনেকে পালিয়ে গেছে। তাই নতুনভাবে ডিলার নিয়োগ দিয়ে আমরা জনগণের চাল ও আটার প্রাপ্তি নিশ্চিত করছি।’

সূত্র : বণিক বার্তা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *