সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। গত ১৯ আগস্ট জারি করা রুলের ওপর শুনানি শেষে ১৭ ডিসেম্বর এই আদেশ দেন বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। রায়ের পর্যবেক্ষণে উচ্চ আদালত বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনী মাধ্যমে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করা হয়েছিল। এর মাধ্যমে দেশের নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়েছিল।
১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান চতুর্দশ সংশোধনীর পরেও ছিল। সুতরাং পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হলে সংবিধান স্বয়ংক্রিয়ভাবে চতুর্দশ সংশোধনীর সময়ে যে অবস্থায় ছিল, সেই অবস্থায় ফিরে যাবে এবং তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনঃস্থাপিত হবে, অনেকেই মনে করছেন এটিই স্বাভাবিক হিসাব। এমনকি অনেক সংবাদ মাধ্যমেও “ফিরে এলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান” এমন ভাবেই খবর প্রকাশিত হয়েছে। তবে বিষয়টি তেমন সরল না। এক কথায় বলা যায়, পঞ্চদশ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনঃস্থাপিত হবে না। কারণ পঞ্চদশ সংশোধনীর প্রক্রিয়াটি যখন চলছিল তখন ২০১১ সালের ১০ মে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানসম্বলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন বিতর্কিত বিচারপতি খাইরুল হকের আপিল বিভাগ এবং এর মাস দেড়েক পরে ৩০ জুন সংসদে পাস হয় পঞ্চদশ সংশোধনী। যেহেতু আপিল বিভাগের রায়ের আলোকে পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি বাদ দেওয়া হয়, সুতরাং এখন হাইকোর্ট পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করে দিলেও তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরবে না। কারণ হাইকোর্ট কখনো আপিল বিভাগের রায় বাতিল বা অবৈধ ঘোষণা করতে পারেন না।
এর অর্থ হলো তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফেরত আনতে হলে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়টি রিভিউ বা পুনর্বিবেচনা চেয়ে যে আবেদন করা হয়েছে, সেটির নিষ্পত্তি হতে হবে। রিভিউতে যদি ত্রয়োদশ সংশোধনী পুনর্বহাল করা হয়, অর্থাৎ ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগের দেওয়া রায়টি যদি রিভিউতে বাতিল হয়ে যায়, তাহলেই কেবল তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহাল হতে পারে। অথবা সংসদের মাধ্যমে নতুন করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সংযোজন করেও তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহাল করা সম্ভব।
আগামী ১৯ জানুয়ারি ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়টি রিভিউয়ের ওপর শুনানির কথা রয়েছে। এই রিভিউয়ে যদি ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়টি বাতিল ঘোষণা করা হয় তবে সংসদের মাধ্যমে নতুন করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সংযোজন ছাড়াই ব্যবস্থাটির পুনর্বহাল করা সম্ভব।
যদিও এরকমটিও মনে করা হয় যে, পঞ্চদশ সংশোধনীর সময় আপিল বিভাগের রায়ের আলোকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করা হলেও, সংসদ যখন সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সংবিধানে কোনো সংশোধনী আনে, তখন আর আদালতের ওই রায়টি খুব বেশি প্রাসঙ্গিক থাকে না। পক্ষান্তরে সংসদ যে আইনই করুক না কেন, এমনকি সেটি যদি সংবিধান সংশোধনও হয়, তারপরও উচ্চ আদালত যদি মনে করেন যে ওই আইন কিংবা সংশোধনীটি সংবিধানের মৌলিক চিন্তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বা সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি, তাহলে সেটি বাতিল বা অবৈধ ঘোষণা করতে পারেন। সেক্ষেত্রে পঞ্চদশ সংশোধনীকে অসাংবিধানিক বলে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছেন, তার আলোকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ যদি এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে এবং রিভিউ হয়, তাহলে সেই আপিল ও রিভিউয়ের নিষ্পত্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল বলে মনে করার সুযোগ নেই।
অতএব সরকার যদি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করতে চায়, তাহলে তার আগেই পঞ্চদশ সংশোধনী এবং একইসঙ্গে ত্রয়োদশ সংশোধনীর রিভিউ নিষ্পত্তি করতে হবে।
বর্তমানে যে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে আছে, তারাও এক ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ফলে তাদের অধীনে নির্বাচন হতে তেমন কোনো সমস্যা হবার কথানা। তবে সেক্ষেত্রে পরবর্তী নির্বাচিত সংসদকে নির্বাচন সহ এই সরকারের কর্মকান্ডের বৈধতা দিতে বিল আনতে হবে।