বিচার বিভাগ
বাংলাদেশের বিচার বিভাগের অধ:পতন আরম্ভ হয়েছিল ২০০৭ সালে এক এগারোর সরকারের আমলে। তখনই বিচার বিভাগে ডিজিএফআই এর কর্তৃত্ব শুরু হয়। আদালতে সেই সময় ডিজিএফআই এর অফিসাররা উপস্হিত থেকে ম্যাজিস্ট্রেট ও জজদের পরিচালনা করতেন। বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করায় যেটুকু রাখঢাক মইন-ফখরুদ্দিনের আমলে ছিল, ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহায়তায় ক্ষমতাসীন হয়ে শেখ হাসিনা সেটাও রাখার আর প্রয়োজন বোধ করেন নাই। আমার দেশ পত্রিকা সর্বপ্রথম বিচার বিভাগের ভয়াবহ দলীয়করণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল। আজকের তরুণ সেই ইতিহাস জানে না এবং আগস্ট বিপ্লবের সুবিধাভোগীরা গোষ্ঠীস্বার্থে সেই সব কথা ভুলেও মনে করবেন না। ২০১০ সালের ১০ মে আমার দেশে “স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা” শিরোনামের মন্তব্য প্রতিবেদনে লিখেছিলাম, “২০০৭ সালের জানুয়ারির ১১ তারিখে জেনারেল মইনের ক্ষমতা দখলের পর থেকে এ দেশের বিচার বিভাগে যে পচনক্রিয়া শুরু হয়েছে শেখ হাসিনার আমলে তা দ্রুততর হয়ে এখন সেখান থেকে রীতিমত দুর্গন্ধ বের হচ্ছে”। সেই লেখার মাশুল আমাকে ডিবি ও র্যাবে রিমান্ডে নির্যাতিত এবং দীর্ঘ সময় জেলে থেকে দিতে হয়েছিল।
আমার সেই মন্তব্য প্রতিবেদনের আর একটি ক্ষুদ্র অংশ প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় উদ্ধৃত করছি, “আজকের বাংলাদেশের আদালতে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে ক্ষমতাসীনরা প্রতিষ্ঠানটিকে রাজনৈতিক নিপীড়ণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। দুর্ভাগ্যক্রমে বিচারকদের মধ্যকার একটি বৃহৎ গোষ্ঠী ক্ষমতাসীনদের এসব অপতৎপরতার বিরুদ্ধে কোন ধরনের প্রতিরোধ সৃষ্টি না করে বরং ন্যক্কারজনকভাবে তাদের সক্রিয় সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন”। লেখাটি ২০১০ সালের, আর আজ ২০২৪ সাল। বিপ্লবী ছাত্র-জনতার প্রবল প্রতিরোধের মুখে আপীল বিভাগের যে আওয়ামী বিচারপতিরা বিতারিত হয়েছেন তারা ২০১০ সালের বিচারপতি নামক দিল্লি ও হাসিনার ক্রীতদাসদেরই উত্তর পুরুষ। আমরা যেন বিজয়ের আতিশয্যে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্হাকে কবর দেয়ার সেই সব প্রাথমিক ও প্রধান দানবদের নাম ভুলে না যাই। জীবনের অন্তিম লগ্নে দাঁড়িয়ে বর্তমানে ইতিহাস এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসেবে ইতিহাসের দায় মেটাতেই সেই নামগুলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আজকের সম্পাদকীয়তে লিখে রাখলাম:
১।খায়রুল হক (বিচার বিভাগের প্রধান খলনায়ক এবং গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকার হত্যাকারী)
২।এস কে সিনহা (সকল জুডিশিয়াল মার্ডারের প্রধান কুশিলব, চরম দুর্নীতিবাজ, নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদের শিষ্য, পরবর্তীতে হাসিনার সঙ্গে ক্ষমতার লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে দেশান্তরী, এবং বর্তমানে ভোল পাল্টানোতে সচেষ্ট)
৩।মোজাম্মেল হোসেন (হাসিনার আজ্ঞাবহ এবং গণতন্ত্র হত্যাকারী)
৪।সৈয়দ মাহমুদ হোসেন (হাসিনার আজ্ঞাবহ এবং গণতন্ত্র হত্যাকারী)
৫।হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী (হাসিনার আজ্ঞাবহ এবং গণতন্ত্র হত্যাকারী)
৬।নিজামুল হক (হাসিনার আজ্ঞাবহ, স্কাইপ কেলেংকারির হোতা এবং জুডিশিয়াল মার্ডারের কুশিলব)
৭।ওবায়দুল হাসান (হাসিনার আজ্ঞাবহ এবং জুডিশিয়াল মার্ডারের কুশিলব)
৮।এনায়েতুর রহিম (হাসিনার আজ্ঞাবহ এবং জুডিশিয়াল মার্ডারের কুশিলব)
৯।শামসুদ্দিন চৌধুরী ওরফে মানিক (চরম দুর্নীতিবাজ, হাসিনার আজ্ঞাবহ, জুডিশিয়াল মার্ডারের কুশিলব, এবং স্যাডিস্ট)
১০।আবদুল মতিন (চরম সুবিধাবাদি এবং প্রধান বিচারপতির পদ না পাওয়ার মন:কষ্টে বর্তমানে সুশীল)
শেখ হাসিনা যে সকল আইনজীবীদের মাধ্যমে উপরের দশ বিচারপতিদের নির্দেশ পাঠাতেন এবং রাজনৈতিক মামলার আগাম রায় সরবরাহ করতেন এবার তাদের তালিকা দিচ্ছি:
১।আনিসুল হক
২।প্রয়াত মাহবুবে আলম
৩।শফিক আহমেদ
৪।প্রয়াত জহিরুল হক ওরফে পিস্তল দুলাল (চরম দুর্নীতিবাজ, সাবেক আইন সচিব)
৫।খুরশিদ আলম (দুদকের আইনজীবী)
৬।মোশাররফ হোসেন ওরফে কাজল (আনিসুল হকের জুনিয়র, দুদকের আইনজীবী, চরম দুর্নীতিবাজ এবং সালমান এফ রহমানের শিষ্য)
৭। এম. আমিন উদ্দিন
৮। প্রয়াত জিয়াদ আল মামুন
৯। গোলাম আরিফ টিপু
১০। রাণা দাসগুপ্ত
হাইকোর্ট এবং ম্যাজিস্ট্রট কোর্ট সম্পর্কে কোন তালিকা দেয়ার প্রয়োজন বোধ করছি না কারণ, বিগত ষোল বছরে ওই দুই জায়গায় যারা নিয়োগ পেয়েছেন তাদের সবাই রক্তপিপাসু দানবের সহযোগী। কম্বল থেকে লোম বাছার চেষ্টা পন্ডশ্রমই হবে। আমার লেখায় যথাসম্ভব ব্যক্তিগত বিষয় আমি এড়িয়ে চলি। আজ হাইকোর্টের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করছি কেবল ওখানে বিচারপতিদের চেয়ারে যারা বসে আছেন তাদের কুৎসিত আওয়ামী, ফ্যাসিবাদি মানসিকতা জাতিকে অবহিত করবার জন্য।
২০১৮ সালের জুলাই মাসে কুষ্টিয়ার আদালতে হাসিনার নির্দেশে এবং পুলিশের সহযোগীতায় আওয়ামী সন্ত্রাসীদের জঙ্গী আক্রমণে গুরুতর আহত হয়ে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন ছিলাম। দুই দিন পরেই আমার সুনামগঞ্জের অপর এক মামলায় নির্ধারিত হাজিরা দেয়া অসম্ভব হওয়ায় মাথায় ব্যান্ডেজ ও গায়ে জ্বর নিয়ে এমবুলেন্সে চড়ে হাইকোর্টে গেলাম। হাইকোর্টের আওয়ামী বিচারপতি চরম ঘৃণা ও প্রচন্ড ক্রোধ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনার চেহারা দেখতে আমাদের ভালো লাগে না। আপনি আজকের পর আর কখনও হাইকোর্টে আসবেন না”। আমি অবশ্যই জানি যে, আমার গায়ের রং খুবই কালো এবং চেহারাও প্রায় কুৎসিতই বলা চলে। কিন্তু, তাই বলে বিচার চাইতেও হাইকোর্টে যেতে পারব না, এ কেমন দেশ, কেমন উচ্চ আদালত? বিচারকদের নাকি ব্যক্তিগত ঘৃণা, বিদ্বেষ থাকতে নেই। সেদিন আমি কিন্তু, হেসেই হাসপাতালে ফিরেছিলাম। সেই ঘটনার একজন স্বাক্ষী ড: ইউনুসের বর্তমান সরকারে আছেন। তিনি হলেন অধিকারের আদিলুর রহমান খান এবং শিল্প ও গণপূর্ত উপদেষ্টা। তিনি সেদিন আইনজীবী হিসেবে আদালতে উপস্থিত ছিলেন।তারপরই আমি দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেই। আমি জীবিত থেকে হাসিনার ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যেতে চেয়েছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ, একুশ শতকের সবচেয়ে নির্মম শাসকের পতন দেখতে পেয়েছি। হাইকোর্টের সেই বিচারপতি নামধারী নরাধম আজও তো বহাল তবিয়তেই জজগিরি করে চলেছেন! তাহলে বিচার বিভাগের প্রকৃত পরিবর্তন আর হলো কোথায়? দেখা যাক, ড: ইউনুসের সরকার, বিশেষ করে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল আদালতকে আওয়ামীকরণ মুক্ত করতে সক্ষম হন কিনা।
পুলিশ-র্যাব
২০১০ সালের ২ জুনের সুবেহ সাদেকের কিছুটা আগে আমার দেশ অফিস থেকে শতাধিক পুলিশের বিশাল বাহিনী এসে আমাকে গ্রেফতার করে। শেখ হাসিনার দানবীয় শাসনকালে দেশের জনগণ মোটামুটি চেনে এমন মানুষদের মধ্যে আমিই প্রথম গ্রেফতার হয়েছিলাম। আমার গ্রেফতারের কয়েক সপ্তাহ পরে জামাতের নেতাদের গ্রেফতার পর্ব শুরু হয়েছিল। আমার প্রথম রিমান্ডের অভিজ্ঞতা হয়েছিল কোতোয়ালী থানায়। “জেল থেকে জেলে” বইটিতে আমার রিমান্ড এবং প্রথম দফার জেলজীবনের দীর্ঘ বর্ণনা রয়েছে। আজ সেগুলোর পুনরাবৃত্তির কোন ইচ্ছা নাই। কেবল কোতোয়ালী থানার প্রবল পরাক্রান্ত তৎকালিন ওসি’র পরিচয় দেয়া এবং অতি সংক্ষেপে আর দুই একটি ঘটনার কথা বলা জরুরী। খুবই আলোচিত কোতোয়ালীর তখনকার ওসিকে আপনারা ওসি সালাহউদ্দিন নামেই চেনেন। এক রহস্যজনক জঙ্গী নাটকে ২০১৬ সালে নিহত হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশে ওসি বলতে প্রধানত: ওই একজনকেই বোঝাতো। ক্রমেই নির্মমভাবে টর্চার, থানায় নিয়ে হাঁটুতে গুলি করে হাড় (Knee Cap) উড়িয়ে দিয়ে পঙ্গু করা এবং মানুষ খুন করা তার নেশায় পরিণত হয়েছিল। শুনেছি এনকাউন্টারে ভিক্টিমের বুক গুলিতে ঝাঁঝরা না করলে তার তৃপ্তি হতো না।
যাই হোক, সন্ধ্যায় ঢাকা সি এম এম আদালত থেকে কোতোয়ালী থানায় নিয়ে আমাকে গারদে রাখা হলো। ঘন্টা দুয়েক পর দেখলাম দোর্দন্ড প্রতাপশালী ওসির আগমনে পুরো থানা সচকিত হয়ে উঠেছে। কিছুক্ষণ পর থানার “জমিদারের” ঘরে আমার ডাক পড়লো। ওসি সালাহ উদ্দিন আমার দিকে তাচ্ছিল্য এবং ঘৃণামিশ্রিত দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে বলতে লাগলেন যে, বিএনপি সরকার কত খারাপ ছিল এবং “আপা” অর্থাৎ শেখ হাসিনা তার কতটা ঘনিষ্ঠ। তিনি এটাও জানাতে ভুললেন না যে, তার বাড়ি গোপালগঞ্জে “আপার” বাড়ির কাছেই। তাদের মধ্যে টেলিফোনে নাকি কথাও হয়। তার একটানা বক্তৃতা শেষ হলে আবার আমাকে পুঁতিগন্ধময় গারদে পাঠানো হলো। বুঝতে পারলাম জনগণের টাকায় প্রতিপালিত পুলিশ শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত বাহিনীতে পরিণত হয়ে যেতে আর বিশেষ বাকী নেই। কোতোয়ালী থেকে আমাকে পরবর্তী রিমান্ডে ক্যান্টনমেন্ট থানায় পাঠানো হলো। সেখানে প্রথম রাতেই একটার দিকে পুরো থানার বাতি নিভিয়ে আমার সেলে চার-পাঁচজন খুনি টর্চার করার জন্য ঢুকলো। আমি দ্রুতই জ্ঞান হারিয়ে ফেললে তারা হয়ত মৃত ভেবে ফেলে রেখে গেছিল। জ্ঞান ফিরে দেখলাম ডিউটি অফিসারের ঘরে পড়ে আছি। সর্বাঙ্গ ভেজা, হয়তো জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টায় পানি ঢেলেছিল। ক্যান্টনমেন্ট থানা থেকে গেলাম ডিবিতে। সেখান থেকে র্যাব-১ এর আয়নাঘরে। টানা দিন দশেকের রিমান্ড শেষের আগের রাতে ঘরে ডেকে নিয়ে তৎকালিন ডিবি প্রধান আমাকে জানালো যে, আমাকে কতটা টর্চার করা হচ্ছে তার রিপোর্ট শেখ হাসিনা এবং সাহারা খাতুনকে নিয়মিত দিতে হয়েছে। তেজগাঁও থানার রিমান্ডের সময় আমাকে জানানো হলো, এসি বিপ্লব সরকার নাকি আমার উপর খুবই ক্ষিপ্ত। এত জুনিয়র একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে আমার তখন ব্যক্তিগতভাবে চেনার কোন কারণ ছিল না। পরে বুঝতে পারলাম বি এন পি’র চীফ হুইপ জয়নাল আবেদিন ফারুকের উপর প্রকাশ্যে বিপ্লব এবং হারুনের প্রায় প্রাণঘাতী আক্রমণের খবর সেই সময় আমার দেশ পত্রিকায় বিষদভাবে ছাপা হওয়ার ফলেই এসি বিপ্লব আমার ওপর বিশেষভাবে খাপ্পা ছিল। পুলিশের ক্রমশ: দানব হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া বোঝানোর জন্যই কয়েকটি প্রাসঙ্গিক ঘটনার উল্লেখ করলাম।
প্রায় ষোল বছরের দানবীয় শাসনকালে শেখ হাসিনা পুলিশকে ব্যবহার করে যে হাজার হাজার হত্যা, নির্যাতন করেছেন সেটি পাঠকরা মোটামুটি জানেন। বিরোধী দলের সব বয়োজৈষ্ঠ নেতাদের রিমান্ডে নিয়ে যে অকথ্য দুর্ব্যবহার করা হয়েছে তার বর্ণনা করে আমি তাদের দ্বিতীয়বার সন্মানহানি করতে চাই না। প্রায় পাঁচ বছরের জেলজীবনে তাদের কাছ থেকে সেই সব ঘটনা শুনে আমার অনেক বিনিদ্র রাত্রি কেটেছে। কাশিমপুর জেল থেকে প্রিজন ভ্যানে ঢাকায় সি এম এম আদালতে যাওয়ার পথে সঙ্গের পাহারাদার পুলিশের কনস্টেবলরা প্রায়ই অহংকার করে বলতো, “শেখ হাসিনাকে তো আমরাই ক্ষমতায় রেখেছি”। একের পর এক গণহত্যা চালিয়েও বেনজির গংদের মধ্যে কোনরকম অনুশোচনা জাতি কখনও দেখে নাই। বরঞ্চ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি হয়েও তারা বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে মালিকসুলভ আচরণ করেছে। গণহত্যা চালিয়ে টেলিভিশনে এসে নিয়মিত বড়াই করেছে। শাপলা চত্বরের গণহত্যার কথা স্মরণ করে বিষন্ন বোধ করি। আগস্ট বিপ্লবে নিহত শহীদদের জাতি আজ সঙ্গত কারণেই বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছে। অথচ, ২০১৩ সালের সেই মাদ্রাসার ছেলেগুলোকে আমরা একেবারেই ভুলে গেছি। তাদের নাম জানারও চেষ্টা করি নাই। এর একটা কারণ হলো শ্রেণিবিদ্বেষ। সেদিনের বিপ্লবীরা গ্রামের দরিদ্র পরিবারের সন্তান ছিল। শহুরে মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তদের গরীবের সন্তান নিয়ে কোন মাথাব্যথা নাই। উপরন্তু, সেদিনের শহীদদের এক বড় অংশই ছিল এতিম। কে আর তাদের কথা মনে করে চোখের পানি ফেলবে? তার ওপর তারা সবাই মাদ্রাসার পড়ুয়া ছিল। ৯০ শতাংশ মুসলমান জনগোষ্ঠীর হতভাগ্য বাংলাদেশে ইসলাম ধর্ম নিয়ে পড়াশোনা তো আবার অমার্জনীয় অপরাধ! প্রথম আলো মার্কা সুশীল সেক্যুলারদের বিবেচনায় হাটহাজারি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করা কূপমন্ডুকতা, কিন্তু ইসকনের স্কুলে কিংবা রামকৃষ্ণমিশনে পড়লে সেটা প্রগতিশীলতা।
ভারতের পরামর্শে এক দানব সরকার ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার অভিলাষে পুরো পুলিশ বাহিনীটিকে আওয়ামীকরণের মাধ্যমে স্যাডিস্ট করে তুলেছিল। এমন অসুস্থ পরিবেশ সৃষ্টির জন্য পুরো বাহিনীকে দোষারোপ করা সমীচিন হবে না। তবে, বাঙ্গালী মুসলমানের স্মৃতিশক্তি বড়ই দুর্বল। দেখতে পাচ্ছি নির্মম ফ্যাসিস্ট শাসক হাসিনাকে পরাভূত করার আনন্দে ইতোমধ্যে তার সহযোগী অপরাধীদের ভুলে যাওয়া শুরু হয়ে গেছে। তাই, ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করার ইচ্ছায় পুলিশ বাহিনীর মধ্যে আমার জানা অনুসারে প্রধান খুনিদের নামগুলো লিখে গেলাম:
১। মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান (লোকটি সেনাবাহিনীর হলেও হত্যাকান্ড চালিয়েছে র্যাবে অন্তর্ভুক্তির পর থেকে)
২। বেনজির অহমেদ
৩। নুর মোহাম্মদ
৪। শহিদুল হক
৫। জাভেদ পাটোয়ারী
৬। আবদুল্লাহ আল মামুন
৭। মনিরুল ইসলাম
৮। আবদুল কাহার আখন্দ
৯। মো: শহিদুল্লাহ (এন এস আই)
১০। হারুন অর রশিদ
১১। বিপ্লব সরকার
১২। মেহেদি হাসান
১৩। প্রলয় কুমার জোয়ার্দার
১৪। কৃষ্ণপদ রায়
১৫। আসাদুজ্জামান মিয়া
১৬। হাবিবুর রহমান
১৭। শফিকুল ইসলাম
১৮। জয় দেব
আমি নিশ্চিত যে, উপরের ১৮ জন ছাড়াও আমার জানার বাইরে আওয়ামী পুলিশের মধ্যে আরো অনেক একই শ্রেণির দানব রয়েছে। সেই নামগুলো আমাদের পুলিশ বাহিনীর মধ্য থেকেই জানতে হবে। রাষ্ট্রের আইন আনুসারে দানব হাসিনার এই সকল খুনীদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করতে আমরা যদি সক্ষম না হই তাহলে ছাত্র-জনতার মহান আগস্ট বিপ্লব ব্যর্থ হয়ে যাবে। আশা করি, বর্তমান শাসকরা ক্ষমতার মোহে কোন আপোষ করে অথবা দুর্বলতার পরিচয় দিয়ে ষোল বছরের দীর্ঘ ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের হাজার হাজার শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করবেন না। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।
নির্বাচন কমিশন
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের জনগণ সর্বশেষ স্বাধীনভাবে ভোট দেয়ার সুযোগ পেয়েছিল। জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে সেই নির্বাচন স্বাধীন হলেও, নির্বাচনটি মোটেও স্বচ্ছ ছিল না। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী তার আত্মজীবনীতে লিখে গেছেন যে, নির্বাচনের মাস দশেক আগেই বাংলাদেশের তৎকালিন সেনাপ্রধান জেনারেল মইনউদ্দিনের ভারত সফরকালে তার সাথে শেখ হাসিনাকে নির্বাচনে জেতানোর বিষয়ে শলাপরামর্শ হয়েছিল। শেখ হাসিনা ক্ষমতা পেলে জেনারেল মইনের চাকরী রক্ষার প্রতিশ্রুতিও দিল্লির তরফ থেকে দেয়া হয়েছিল। প্রণব মুখার্জী সেই সময় কংগ্রেস সরকারের খুবই প্রভাবশালী পররাষ্ট্র মন্ত্রি ছিলেন।
দেশদ্রোহী জেনারেল মইন ভারত থেকে কয়েকটি ঘোড়া উপহার নিয়ে বাংলাদেশে ফিরেই যে কোন মূল্যে শেখ হাসিনাকে নির্বাচনে জেতানোর কলাকৌশল আরম্ভ করে দিয়েছিলেন। তার সেই রাষ্ট্রবিরোধী অপকর্মে ড: শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন তৎকালিন নির্বাচন কমিশন সোৎসাহে মদদ দিয়েছিল। সেই নির্বাচন কমিশনে বাকী দুই কমিশনার ছিলেন আমলা ছহুল হোসেন এবং ব্রি:জে: (অব:)সাখাওয়াত। প্রয়াত ছহুল হোসেন পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ নির্বাচনে নমিনেশন পাওয়ার চেষ্টা করে কেন জানিনা ব্যর্থ হয়েছিলেন। আর ভাগ্যবান ব্রি:জে: (অব:)সাখাওয়াত বিস্ময়করভাবে “আগস্ট বিপ্লব” পরবর্তী বর্তমান অন্তর্বর্তীকালিন ড: ইউনুস সরকারের বস্ত্র ও পাট উপদেষ্টা। ভুলো মনের বাঙ্গালী মুসলমানের স্মৃতি জাগিয়ে তোলার জন্য শামসুল হুদা কমিশনের কিছু কর্মকান্ডের উল্লেখ করছি:
১। কমিশন প্রথমেই বি এন পি ভাঙ্গার কৌশল গ্রহণ করেছিল। ডিজিএফআই এর অতি প্রভাবশালী আমিন-বারি জুটি মান্নান ভুঁইয়ার নেতৃত্বে এক নতুন বিএনপি করার সর্বরকম প্রচেষ্টা নেয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকারের সাথে নির্বাচন নিয়ে আনুষ্ঠানিক সংলাপ শুরু হলে শামসুল হুদা কমিশন বেগম খালেদা জিয়া মনোনিত বৈধ মহাসচিব মরহুম খন্দকার দেলোয়ারের পরিবর্তে ডিজিএফআই সৃষ্ট ভেজাল বিএনপির মহাসচিব মেজর(অব:) হাফিজকে সংলাপে অংশগ্রহণের আমন্ত্রন জানায়।
২। শামসুল হুদা কমিশন এমনভাবে সংসদীয় সীমানা নতুন করে নির্ধারন করে যাতে করে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে জয়লাভের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। উদাহরণ স্বরূপ, বিএনপি সমর্থক এলাকা বলে পরিচিত মানিকগঞ্জে সংসদীয় আসন সংখ্যা পূর্বের চার থেকে কমিয়ে তিনে নিয়ে আসে। ২০০১ সালের নির্বাচনে মানিকগঞ্জের চারটি আসনেই বিএনপি বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছিল। এমন প্রক্রিয়া ৩০০ আসনেই চালানো হয়।
৩। নির্বাচনের মাত্র কয়েকদিন আগে জেনারেল মইন নির্বাচন কমিশনার ব্রি: জে: সাখাওয়াতের সাথে কক্সবাজারে এক গোপন বৈঠক করেন বলে সেই সময় প্রচারিত হয়েছিল। এমন কোন বৈঠক হয়েছিল কিনা এবং হয়ে থাকলে সেখানে কি আলোচনা হয়েছিল সেটি ড: ইউনুস সরকারের উপদেষ্টাই ভাল বলতে পারবেন। স্বচ্ছতার খাতিরে এ বিষয়ে তার মুখ খোলা উচিৎ।
৪। বিশ্ববাসী ২০১৮ সালের নির্বাচনে আগের রাতেই ব্যালট বাক্স নৌকার পক্ষে ভরে রাখার কাহিনী মোটামুটি জানে। সেই সময়কার জাপানী রাষ্ট্রদূত বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্য মন্তব্য করে বাংলাদেশ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। কিন্তু, একই প্রকার অনিয়মের যে ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশে একেবারেই আলোচনা হয় না তা হলো, নৌকার পক্ষে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার কৌশল ড: শামসুল হুদা কমিশনই ২০০৮ সালের নির্বাচনে শিখিয়ে গেছে। কেমন করে সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এক অসম্ভব ভূমিধ্বস বিজয় সম্ভব করানো হয়েছিল এবং পরিণামে বাংলাদেশে কি হতে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে নয়া দিগন্ত পত্রিকায় আমি ২০০৯ সালের জানুয়ারী মাসে পাঁচ কিস্তিতে ধারাবাহিকভাবে লিখেছিলাম (প্রধান নির্বাচন কমিশনার কী চমৎকার কথা রাখলেন-৪/১/২০০৯, পরিসংখ্যান কথা বলে-৭/১/২০০৯, কেন এই অসম্ভব ফলাফল?-১৪/১/২০০৯, কেন এই অসম্ভব ফলাফল?-২১/১/২০০৯, এবং পরবর্তী লড়াই-২৮/১/২০০৯)। উল্লিখিত লেখাগুলো আমার “১/১১ থেকে ডিজিটাল” বইতে পাওয়া যাবে। উৎসাহী পাঠক চাইলে পড়তে পারেন। ড: শামসুল হুদা এবং ব্রি: জে: (অব:) সাখাওয়াত এখন সুশীলের ভূমিকায় অবতীর্ন হলেও ফ্যাসিবাদ কায়েমে তাদের দায়মুক্তি ঘটার কোন সুযোগ নাই।
এতো গেল শামসুল হুদা কমিশনের কীর্তিকলাপ। এরপর এলো রকিব কমিশন। তারা ২০১৪ সালে আর এক রকম তেলেসমাতি দেখালো। নির্বাচনের আগেই ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত হওয়ার ইতিহাস পৃথিবীর আর কোন দেশে আছে কিনা আমার অন্তত: জানা নাই। অর্থাৎ, রকিব কমিশনের তেলেসমাতিতে নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগ সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গিয়েছিল। বাকশালী কায়দায় শেখ হাসিনা টানা দ্বিতীয়বার সম্পূর্ণ বেআইনী প্রধানমন্ত্রী বনে গেলেন। জাতির সাথে কী বীভৎস তামাশা! আর কারা ছিল সেই রকিব কমিশনে তাদের তালিকাও নীচে দিলাম:
১। রকিবউদ্দিন আহমেদ-প্রধান নির্বাচন কমিশনার
২। মোহাম্মদ শাহনওয়াজ
৩। ব্রি: জে: (অব:) জাভেদ আলী
৪। মোহাম্মদ আবদুল হাফিজ
৫। মোহাম্মদ আবদুল মোবারক
তারপর ২০১৮ সালে নুরুল হুদা কমিশনের নৈশ ভোটের পালা। আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভরার কেরামতি দেখে সারা বিশ্ব নির্বাক। সিসি-পুটিনরা কেন যে নুরুল হুদাকে বিশেষ সন্মান দিয়ে ইজিপ্ট কিংবা রাশিয়ার নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব দিচ্ছে না ভেবে পাই না। ২০০৮ এবং ২০১৮ সালে দুই হুদা বাংলাদেশে দানব হাসিনার উত্থানে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। নুরুল হুদার অন্যান্য সাঙ্গাৎদের ভুলে যাওয়া খুবই অন্যায় হবে। তারা হলেন:
১। শাহাদাত হোসেন চৌধুরী
২। কবিতা খানম
৩। রফিকুল ইসলাম
৪। মাহবুব তালুকদার***
মরহুম মাহবুব তালুকদার নামটির পাশে তিনটি তারা চিহ্ন দিয়েছি কারণ তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যে, একদল নির্লজ্জ ক্রিমিনালদের মাঝে অবস্থান করেও, অসীম সাহসের সাথে জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। মাহবুব তালুকদার আমার দেশ পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতেন। তিনি সফল না হলেও তার বীরোচিত সংগ্রামের কথা আমরা যেন ভুলে না যাই। মহান আল্লাহতায়ালার কাছে তার উত্তম পুরষ্কারের জন্য বিনীতভাবে দোওয়া করছি।
সর্বশেষ ২০২৪ সালে বাকপটু আওয়াল কমিশন জাতিকে “ডামি নির্বাচন” দেখিয়েছে। সুশীলের মুখোশধারী ক্রিমিনাল হাবিবুল আওয়াল তার সুন্দর বাক্য দ্বারা মরহুম ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরিকেও বিভ্রান্ত করে ফেলেছিলেন। ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী হাবিবুল আওয়ালের নিয়োগকে কি আশায় যেন স্বাগত: জানিয়েছিলেন। মানুষ মাত্রই ভুল হয়। এই ক্ষেত্রে আমাদের প্রিয় জাফর ভাইও ভুল করেছিলেন। ডামি নির্বাচনের অন্য কুশিলবরা হলেন:
১। মোহাম্মদ আলমগীর
২। আনিসুর রহমান
৩। আহসান হাবিব খান
৪। রাশিদা সুলতানা
২০০৮ সাল থেকে যে ১৮ জন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পেয়েছেন তাদের মধ্যে একমাত্র মরহুম মাহবুব তালুকদার ছাড়া বাকী ১৭ জন শেখ হাসিনা নামক দানবের উত্থানে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এই সময়কালের নির্বাচন কমিশনের সচিবরাও একই জাতের অপরাধী। আমি মনে করি বাংলাদেশে গণতন্ত্র হত্যা এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ভারতের পদতলে অর্পণ করার প্রক্রিয়ায় সহযোগীরূপে এদের প্রত্যেকের বিচার হওয়া উচিৎ। বিপ্লবী ছাত্র-জনতার এদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে।
মিডিয়া ও সুশীল সমাজ
১৯৭১ সালে ভূরাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবেই ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা দিয়েছিল। ১৯৪৭ সালে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন অবসানের পর থেকেই দিল্লির উদ্দেশ্য ছিল বৃটিশ-রাজের অলিখিত উত্তরাধিকারির ক্ষমতা গ্রহণ করে দক্ষিণ এশিয়ায় একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করা। কিন্তু, অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তিতে তুলনামূলকভাবে দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান ভারতের সেই হেজেমনিক ইচ্ছায় শুরুতেই বাগড়া দিয়ে বসে। ১৯৪৭ এবং ১৯৬৫ সালের দুই যুদ্ধতেও ভারত পাকিস্তানকে হারাতে সক্ষম হয় নাই। ফলে সামরিক দিক দিয়ে উপমহাদেশে এক ধরনের স্থিতাবস্থা তৈরি হয়েছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভারতকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় লাভের এক মোক্ষম সুযোগ এনে দেয়। বাংলাদেশে গণহত্যা চালানোর অপরাধে নৈতিকভাবে দুর্বল পাকিস্তান সেই যুদ্ধে পর্যূদস্ত হয় এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। অর্থাৎ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ভারত এবং বাংলাদেশ উভয়ের জন্য একটি লাভজনক (Win-Win) ঘটনা ছিল। বাংলাদেশের জনগণ তাদের কাঙ্খিত স্বাধীনতা লাভ করেছিল এবং ভারত চিরশত্রু পাকিস্তানকে দ্বিখন্ডিত করে হীনবল করার পাশাপাশি পূর্ব সীমান্তে আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং কৌশলগত স্বার্থ উদ্ধার করেছিল। অথচ, ৫৩ বছর ধরে বাংলাদেশের তথাকথিত চেতনাজীবীরা ভারতের আধিপত্যবাদি স্বার্থ উদ্ধারে একচেটিয়াভাবে আমাদের ভারতের কাছে এমন এক অপরিশোধ্য ঋণের বয়ান ফেরি করে গেছে যাতে করে সমগ্র জাতি এক বানোয়াট কৃতজ্ঞতার ভারে দিল্লির প্রভুদের কাছে অনন্তকাল নুয়ে থাকে। বহুকাল বাদে জাতির সেই নুয়ে পড়া মেরুদন্ড সোজা হতে দেখে জীবনের পড়ন্ত লগ্নে আশান্বিত হয়েছি।
উপরোক্ত বয়ান বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য দিল্লি স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের মিডিয়ার উপর ভর করে। ফলে, বিগত অর্ধ শতকে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের অধিকাংশ মালিক এবং সম্পাদক ভারতীয় আধিপত্যবাদের দালালে পরিণত হয়েছে। যে দু-একটি মিডিয়া বিভিন্ন সময় ভিন্নমত প্রচারের মাধ্যমে জনগণকে ভারতীয় হেজেমনির স্বরূপ সম্পর্কে সতর্ক করার চেষ্টা করেছে সেগুলোকেই নানা প্রক্রিয়ায় বাধাগ্রস্থ এমনকি বন্ধ করা হয়েছে। গণমাধ্যমের বিভিন্ন সংগঠনকেও ভারতীয় দালাল শ্রেণি দীর্ঘদিন ধরে কুক্ষিগত করে রেখেছে। উদাহরণ হিসেবে পত্রিকা মালিকদের সংগঠন, “নোয়াব” এবং সম্পাদকদের সংগঠন, “সম্পাদক পরিষদের” কথা বলা যেতে পারে। পতিত ফ্যাসিস্ট হাসিনার সহযোগী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং সুশীলত্বের দাবিদার, ভারতপন্থী ও ইসলামবিদ্বেষী প্রথম আলো-ডেইলি স্টার গ্রুপ যথাক্রমে উল্লিখিত সংগঠনগুলো বরাবর নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আমার দেশ জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করলেও পত্রিকাটিকে দুই সংগঠনের কোনটারই সদস্যপদ দেওয়া হয় নাই। শুধু তাই নয়। স্কাইপ কেলেংকারির ঘটনা এবং শাহবাগের কথিত গণজাগরণে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও দেশের ইসলামবিদ্বেষীদের যোগসাজসের কাহিনী আমার দেশে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হলে শেখ হাসিনার সরকার পত্রিকাটি বেআইনীভাবে বন্ধ করে দিলে প্রথম আলো-ডেইলি স্টার গ্রুপসহ ভারতের দালাল সুশীল ও মিডিয়াগোষ্ঠী তাতে পুরোপুরি ইন্ধন দিয়েছিল।
ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রায় ১৬ বছরের অপশাসনকালে আমরা গণমাধ্যমের মালিক, সম্পাদকদের হয় শেখ হাসিনার পদলেহন ও চাটুকারিতার নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা করতে অথবা সুবিধাবাদি মৌনতা অবলম্বন করতে দেখেছি। মাহফুজ আনাম এবং মতিউর রহমানের মত সুশীল, ইসলামবিদ্বেষী, ডাকসাইটে সম্পাদকরা যারা ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সত্য, অর্ধসত্য এবং অসত্য তথ্যের উপর ভিত্তি করে প্রায় প্রতিদিন বিএনপি সরকারের তীব্র সমালোচনা করে সংবাদ প্রকাশ করতো ও সম্পাদকীয় লিখতো তারা মহা পরাক্রমশালী শেখ হাসিনার কৃপা ভিক্ষা করতে কোনরকম লজ্জাবোধ করে নাই। মাহফুজ আনাম তো কিছু দিন পরপর স্বনামে সম্পাদকীয় লিখে শেখ হাসিনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে গেছেন যে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে তারা কতটা পরিশ্রম করেছেন। খুনী হাসিনার মন পাওয়ার এই সব প্রাণান্তকর চেষ্টা একেবারে ব্যর্থ হয় নাই। মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে অনেক মামলা হলেও তাকে কখনও রিমান্ড অথবা জেলে যেতে হয় নাই। সরকার পরিবর্তনের পর প্রথম আলো ভোল পাল্টাচ্ছে দেখে বেশ আনন্দ বোধ করছি। পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদক, ভারত ও আওয়ামী লীগের চিহ্নিত ও একনিষ্ঠ সমর্থক, চরম ইসলামবিদ্বেষী আনিসুল হক বিপ্লব পরবর্তী সময়ে আওয়ামী সরকারের ভুল নিয়ে “সস্নেহে” প্রায়ই কলাম লিখছেন। সেই কলামগুলি পড়লেই হাসিনাপতনে তার অন্তরের বেদনা টের পাওয়া যায়। একদা প্রথম আলোর বিবেচনায় বাম আদর্শভ্রষ্ট ফরহাদ মজহারের সংবাদ এবং বক্তৃতা-বিবৃতি সুশীল পত্রিকাটি এখন নিয়মিত ছাপাচ্ছে। ড: ইউনুস উপদেষ্টা মন্ডলির সদস্য ফরিদা আখতার যে, ফরহাদ মাযহারের স্ত্রী সেটা অবশ্যই প্রথম আলোর বিবেচনায় আছে। এটাকেই বলে ব্যবসায়ী বুদ্ধি যা আমার আবার কোনকালেই ছিল না।
আমার দেশ বন্ধ হওয়ার পর দেশের দৈনিক পত্রিকা সমূহের মধ্যে একমাত্র মানবজমিন স্বয়ং-আরোপিত সেন্সরের মধ্যে থেকেও মাঝেমধ্যে কিছু খবর পাঠককে দেয়ার চেষ্টা করেছে। সেটুকু সাহস দেখানোর অপরাধে পত্রিকাটির সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীকে দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকতে হয়েছিল। চরম বৈরী সময়ে নয়া দিগন্ত নানা কৌশলে কেবল টিকে থাকার চেষ্টা করে গেছে। এছাড়া, বাকি পত্রিকা নামক আবর্জনাসমূহের সম্পাদক যারা ছিল তাদের সম্পর্কে কিছু লিখতেও আমার ঘৃণা হয়।
শেখ হাসিনার ভয়ংকর দানব শাসনকে বাংলাদেশের তথাকথিত সুশীল সমাজ দেখেও না দেখার ভান করে প্রকারান্তরে সমর্থন দিয়ে গেছে। সেই সুবাধাবাদী সুশীল সমাজের অনেকেই আবার বিপ্লব পরবর্তী বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদের শোভা বর্ধন করছে। এই সুশীলদের অধিকাংশই একনিষ্ঠ ভারতপ্রেমী হলেও জনমত বুঝতে পেরে এখন ভারতবিরোধী ভাব দেখানোর চেষ্টায় রত। দেখলাম ড: দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বাংলাদেশের ধ্বংসপ্রায় অর্থনীতিকে দিক নির্দেশনা দেওয়ার গুরু দায়িত্ব পেয়েছেন। বিচিত্র বাংলাদেশে সবই সম্ভব। এই ড: দেবপ্রিয়ই বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বিসর্জনকারি এক-এগারো সরকারের সময়ে জেনেভায় রাষ্ট্রদূতের পদ পেয়েছিলেন। তার বিদেশী স্ত্রীর জন্য সেই সময় দেশের আইনও বদলানো হয়েছিল। সিপিডির ব্যানারে ড: দেবপ্রিয়ই বাংলাদেশের বুক চিরে ভারতকে করিডোর দেওয়ার জন্য বিদেশী অর্থে প্রায় প্রতিদিন সভা-সেমিনার করেছেন। বাংলাদেশকে ট্রানজিটের টাকায় সিংগাপুর বানানোর অলীক স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তিনি বিএনপি সরকারকে হঠিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাসীন করার কৌশল হিসেবে এক বায়বীয় “যোগ্য প্রার্থী আন্দোলন” প্রকল্প নিয়ে এক সময় দেশ চষে বেড়িয়েছেন। সেই সব কর্মকান্ডের টাকাপয়সা তিনি কোথা থেকে পেতেন সেটা দেশবাসীকে কখনও জানানো হয় নাই। হয়ত নিজের টাকা দিয়েই দেশ উদ্ধারে নেমেছিলেন! তবে, দানবীয় ফ্যাসিস্ট শাসনের ভয়ংকর ষোল বছরে সেই আন্দোলনের আর কোন সাড়াশব্দ আমরা শুনতে পাই নাই। হয়ত দেবপ্রিয় বাবু ভেবেছিলেন যে, আওয়ামী লীগের সব নেতাই যোগ্য ছিলেন। আগস্ট বিপ্লবের তরুণরা সুশীল মহারথীদের এই সব কাহিনী জানে কিনা আমার সে সম্পর্কে ঘোরতর সন্দেহ হয়।
সুশীল সংগঠন টিআইবি’র বিষয়টাই বিবেচনা করুন। ২০০০ সাল থেকে ২০০৩ পর্যন্ত তাদের জরিপে বাংলাদেশ নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ দেশ ছিল। অথচ, স্বয়ং শেখ হাসিনা তার পিয়নের কাছেও ৪০০ কোটি টাকা আছে প্রকাশ্যে বলে এক প্রকার দম্ভ দেখালেও এবং শত বিলিয়ন ডলার দেশ থেকে পাচার হয়ে গেলেও বাংলাদেশ এখন আর দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয় না। টিআইবি’র প্রধান ব্যক্তি ড: ইফতেখারুজ্জামানের বন্ধু বান্ধবদের কাছ থেকে শুনেছি যে, দানব, রক্তপিপাসু, চরম দুর্নীতিবাজ, হাসিনাকে এই বিশিষ্ট সুশীল সর্বদা সমর্থন করে বলতেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় বাংলাদেশে সেই নাকি মন্দের ভাল। টিআইবি’র ভোল পাল্টানো নিয়ে ২০১২ সালের ৪ জুলাই আমার দেশ পত্রিকায় “বল্গাহীন দুর্নীতি ও ম্রিয়মাণ টিআইবি” শিরোনামে আমি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখলে ড: ইফতেখারুজ্জামান তার প্রতিবাদ পত্র পাঠিয়েছিলেন এবং আমার দেশে আমরা সেই পত্র হুবহু ছাপিয়েছিলাম। টিআইবি’র প্রতিবাদ পত্রের জবাবে ১৮ জুলাই ২০১২ “টিআইবি’র সময়-অসময়” শিরোনামে আমি আর একটি মন্তব্য-প্রতিবেদন লিখলে ড: ইফতেখারুজ্জামান চুপ করে গেছিলেন। ২০১৩ সালের বইমেলায় প্রকাশিত আমার “জয় আসলে ভারতের” বইতে উল্লিখিত দুটি মন্তব্য-প্রতিবেদনই পাওয়া যাবে। উৎসাহী পাঠক পড়ে দেখতে পারেন। ড: ইউনুসের উপদেষ্টা মন্ডলিতে ড: ইফতেখারুজ্জামানের অন্তর্ভূক্তির অপেক্ষায় আছি। আরো অনেক সুশীল দেশে-বিদেশে গর্তে লুকিয়ে আছে। সবার কথা লিখতে গেলে লেখার কলেবর অনেক বাড়াতে হবে। এই বুড়ো বয়সে সেই কষ্ট করেই বা কি লাভ? বাঙ্গালী মুসলমানের সেগুলো ভুলতে তেমন একটা সময় লাগবে না।
২০০৯ সালের ৪ এপ্রিল আমার দেশে প্রথম লিখেছিলাম যে, শেখ হাসিনা ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চলেছে। এতটা আগাম ভবিষ্যদ্বাণী পাঠকের বিশ্বাস করতে কষ্ট হলে ২০১১ সালের বইমেলায় প্রকাশিত আমার “নবরূপে বাকশাল” বইটির “ফ্যাসিবাদের দিকে ধাবমান সরকার” শিরোনামের লেখাটি পড়তে পারেন। ২০১৩ সালে আমার দেশের বিখ্যাত শিরোনাম, “শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি” হয়ত এখনও কিছু ব্যক্তির মনে থাকলেও আমি নিশ্চিত যে, আমার ২০০৯ সালের লেখাটির কথা কারো স্মরণে নাই। ড: ইউনুস এবং তার উপদেষ্টা মন্ডলির সব বিশিষ্ট, মহাজ্ঞানী ব্যক্তিরা আমার মত নগন্য মানুষের পুরনো লেখা পড়ে সময় নষ্ট করবেন এটা নিতান্তই দুরাশা। তবে আগস্ট বিপ্লবের প্রকৃত নায়কদের বলবো, একটু সময় নষ্ট হলেও সেগুলোতে চোখ বুলাতে। ফ্যাসিস্ট শাসনের ইতিহাস না জানলে বিপ্লব ধরে রাখা যাবে না।
১৪ দল, জাতীয় পার্টি, ও রাজনৈতিক ভাঁড়ের দল
১৪ দল, জাতীয় পার্টি, ও রাজনৈতিক ভাঁড়ের দল শেখ হাসিনার ১৬ বছরের ফ্যাসিস্ট শাসনকালে তার একচ্ছত্র ক্ষমতা গ্রহণপূর্বক এক রক্তপিপাসু, দানব শাসকে রূপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়ায় কয়েকটি দল এবং কয়েকজন রাজনীতিবিদ বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। ফ্যাসিবাদের একনিষ্ঠ সমর্থক দলের মধ্যে জাসদ (ইনু), ওয়ার্কার্স পার্টি (মেনন), সাম্যবাদী দল (বড়ুয়া), জাতীয় পার্টি (মঞ্জু), এবং এরশাদের জাতীয় পার্টি উল্লেখযোগ্য। এসব দলের ফ্যাসিবাদ ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের সমর্থনকারী প্রধান রাজনৈতিক নেতারা হলেন,
১। হাসানুল হক ইনু
২। রাশেদ খান মেনন
৩। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু
৪। রওশন এরশাদ
৫। দিলীপ বড়ুয়া
৬। গোলাম মোহাম্মদ কাদের
৭। নজিবুল বশর
৮। ফজলে হোসেন বাদশা
৯। শিরিন আখতার
১০। প্রয়াত মইনুদ্দিন খান বাদল
১১। প্রয়াত হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ
উপরোক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক যেমন, ইনু-মেনন গং চরম ইসলামবিদ্বেষী ধ্যানধারণা লালন করার ফলে আদর্শিকভাবেই তারা বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ ও হিন্দুত্ববাদের উত্থানে সোৎসাহে সমর্থন জুগিয়েছে। বাদবাকিরা ষোল বছরের লাগামছাড়া দুর্নীতির সুবিধা নিতে এবং ভারত প্রীতির কারণে নির্লজ্জভাবে হাসিনার পদলেহন করে গেছে। প্রসঙ্গক্রমে এরশাদের জাতীয় পার্টির ভারতের প্রতি দাসসুলভ আচরণের দুটি উদাহরণ এখানে দেয়া যেতে পারে।
২০১৪ সালের নির্বাচন সকল বিরোধী দল বর্জন করেছিল। জনমতের চাপে প্রাথমিকভাবে এরশাদও নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়। দেশে তখন তুমুল সরকারবিরোধী আন্দোলন চলছিল। সারা দেশ প্রায় অচল। অবস্থা বেগতিক দেখে দিল্লির তৎকালিন কংগ্রেস সরকার পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংকে বিশেষ মিশনে ঢাকায় পাঠায়। সুজাতা সিং ঢাকায় এসেই এরশাদের সাথে দেখা করে তাকে তামাশার নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য চাপ সৃষ্টি করে সফল হয়। ভারতের মদদে ভুয়া, একদলীয় নির্বাচনের পর বাংলাদেশে এক আজব সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় যেখানে জাতীয় পার্টি একাধারে সরকারের অংশ এবং সংসদে বিরোধীদলের ভূমিকা পালন করে। এরশাদকে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এবং রওশন এরশাদকে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় বিরোধী দলীয় নেতা বানানো হয়। ভারতের হস্তক্ষেপে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের কবর রচনা করা হয়।
জাতীয় পার্টির দিল্লির গোলামীর দ্বিতীয় উদাহরণ বেশ সাম্প্রতিক। গত বছর এরশাদের ভাই গোলাম কাদের হাসিনার অধীনে এক দলীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করবার ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন। সে অবস্থায় তিনি হঠাৎ ভারত সফরে যান। দিল্লিতে তিনি ভারতের কোন নেতার সাথে দেখা করেছিলেন এবং সাক্ষাতে কি আলোচনা হয়েছে সেগুলো জনগণকে জানাতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যে, ভারতের অনুমতি ছাড়া সে সব কথা প্রকাশ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। অর্থাৎ, বাংলাদেশের জনগণের প্রতি তার কোন দায়বদ্ধতা নাই, তিনি দিল্লির হিন্দুত্ববাদী সরকারের একজন পুতুল মাত্র! গোলাম কাদেরের এই বক্তব্য পরিষ্কারভাবেই রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং চক্রান্তমূলক। বাংলাদেশের জনগণেরই এখন বিবেচনা করা উচিৎ যে, প্রকাশ্যে ভারতের কাছে গোলামীর স্বীকৃতি প্রদানের পর জাতীয় পার্টি এই দেশে কোন বৈধ রাজনৈতিক দল হিসেবে থাকতে পারে কিনা।
উপরে উল্লিখিত ফ্যাসিস্ট সহযোগী রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ গ্রেফতার হয়েছেন। দেখতে পাচ্ছি তাদের বিরুদ্ধে হত্যাসহ অন্যান্য মামলা হয়েছে। তাদেরকে রিমান্ডেও নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের আইনে খুন কিংবা খুনের সহযোগিতার সাজা অবশ্যই সর্বোচ্চ। তবে আমার বিবেচনায় ছাত্র-জনতার মহান বিপ্লব নস্যাৎ করার লক্ষ্যে গণহত্যায় সহযোগিতার থেকেও অধিকতর গর্হিত অপরাধ এই ব্যক্তিরা করেছেন। তারা ১৭ কোটি জনগোষ্ঠীর পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই হত্যা করেছিলেন। বিদেশী শক্তির এজেন্ট রূপে বাংলাদেশ নামক সার্বভৌম রাষ্ট্রটিকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছেন এবং ফ্যাসিবাদের দোসর হয়ে জনগণের সকল অধিকার কেড়ে নিয়েছিলেন। এসকল অপরাধে বাংলাদেশ সরকারের উচিৎ এদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করা। সে সমস্ত মামলায় এরা দোষী সাব্যস্ত হলে বাংলাদেশে তাদের পরিচালিত দলগুলোর আর রাজনীতি করবার অধিকার থাকবে কিনা সেটি আদালত নির্ধারণ করবে।
উপরোক্ত নেতৃবৃন্দ ছাড়াও আরো কিছু রাজনৈতিক ভাঁড় বিভিন্ন সময়ে এবং প্রক্রিয়ায় দানব শেখ হাসিনাকে তার ষোল বছর ব্যাপী ভয়ংকর ফ্যাসিস্ট শাসন টিকিয়ে রাখতে এবং দীর্ঘায়িত করতে সহযোগিতা করেছে। তাদের নাম আমরা যেন সহজেই ভুলে না যাই সে জন্য ঐ ব্যক্তিদেরও একটি তালিকা নীচে দিলাম:
১। মেজর জেনারেল (অব:) ইবরাহিম
২। ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর
৩। শামসের মবিন চৌধুরী
৪। তৈমুর আলম খন্দকার
৫। কাদের সিদ্দিকী
৬। প্রয়াত নাজমুল হুদা ও তার পরিবার
৭। মাহি বি চৌধুরী
৮। শাহ মো: আবু জাফর
৯। মিসবাহুর রহমান চৌধুরী
১০। মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম
১১। প্রয়াত আবদুল লতিফ নেজামী
আমার স্মৃতিশক্তির দুর্বলতায় রাজনৈতিক ভাঁড়দের কারো নাম তালিকা থেকে বাদ পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পাঠকরা সেই নামগুলো যোগ করে নেবেন।
বাংলাদেশের জনগণের উপর অবর্ণনীয় জুলুম চালিয়ে রাষ্ট্রকাঠামো ধ্বংস করে দেয়ার প্রধান অপরাধী অবশ্যই রক্তপিপাসু, দানব চরিত্রের শেখ হাসিনা। তবে তাকে দানব হয়ে উঠতে যারা প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছে তাদের অপরাধও কম নয়। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের পতনের পর আমরা তার বাকশালী স্বৈরশাসনের সহযোগীদের উপযুক্ত শাস্তি না দিয়ে যে ভুল করেছিলাম তারই কাফফারা জাতি ১৬ বছর ধরে দিয়েছে। মহান আল্লাহতায়ালার অসীম অনুগ্রহে আমাদের তরুণ সমাজ একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ ফ্যাসিস্ট শাসককে কোন বিদেশী সাহায্য ছাড়া এক মহান বিপ্লবে উৎখাত করতে সক্ষম হয়েছে। সেই বিজয় সংহত করতে হলে এবার আর আমাদের ভুল করলে চলবে না। সেই দায়িত্ববোধ থেকেই, দিল্লির দালাল, দেশবিরোধীদের জনগণের সামনে চিনিয়ে দেয়ার জন্য আমার সাধ্যমত কাজ করে যাচ্ছি। মনে রাখতে হবে যে, প্রতিবিপ্লবীরা কিন্তু বসে নেই। কাজেই যত দ্রুত সম্ভব ফ্যাসিবাদের দালালদের চিহ্নিত করে তাদের প্রাপ্য শাস্তি নিশ্চিত করা আবশ্যক। তাহলেই ষড়যন্ত্রকারীরা ইনশাআল্লাহ পরাভূত হবে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
বর্তমান শতকে বাংলাদেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদের সার্বিক বিস্তারের সূচনা হয়েছিল এক এগারো সরকারের আমলে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জুনিয়র বুশের শাসনকালে মোটামুটি একপাক্ষিক (Unipolar) বিশ্বব্যবস্থায় বাংলাদেশে বিএনপির নেতৃত্বে তৎকালিন চারদলীয় সরকার খানিকটা ইসলামপন্থী ও স্বাধীনচেতা হওয়ার ফলে ওয়াশিংটনের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমি ২০০৩ সালের কথা বলছি। ততদিনে আফগানিস্তানে মার্কিনীদের দখলদারিত্ব আরম্ভ হয়েছে। বুশ প্রশাসন ন্যাটোর দখলদার বাহিনীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপস্থিতির আকাঙ্ক্ষা জানালে সঠিকভাবেই প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তাতে সম্মত হন নাই যা ওয়াশিংটনের বিরক্তি বৃদ্ধি করেছিল। ভারত বিশ্ব ভূরাজনীতিতে মার্কিন প্রভুত্ব ও ইসলামবিদ্বেষের সেই সুযোগ গ্রহণ করে বাংলাদেশে সেনাবাহিনীতে ব্যাপক মাত্রায় তার এজেন্টদের অনুপ্রবেশ ঘটাতে সক্ষম হয়। এই অবস্থায় ২০০৫ সাল থেকেই সেনাবাহিনীর মধ্যে ভারত এবং আওয়ামী প্রীতি বৃদ্ধি পেয়ে পর্যায়ক্রমে মইন-মাসুদের নেতৃত্বে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারী বাংলাদেশে এক ভারতপন্থী অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। অভ্যুত্থানের প্রাথমিক পর্যায়ে বহুল আলোচিত “মাইনাস টু” এর মাধ্যমে সেটিকে বিরাজনীতিকরণের পদক্ষেপ হিসেবে প্রচার করা হলেও প্রকৃতপক্ষে দিল্লির পুতুল ও দানব শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আনাই ছিল সকল দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের মুখ্য উদ্দেশ্য।
বিএনপিকে দুই টুকরো করবার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলে দিল্লির সাথে মিলে এক এগারো সরকার ২০০৮ সালের সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে একচেটিয়াভাবে বিজয়ী করবার পরিকল্পনায় সফল হয়। তৎকালিন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ২০০৮ এর শুরুতে ভারত সফরে গিয়ে হাসিনাকে ক্ষমতায় আনা এবং তার ব্যক্তিগত লাভের সকল বন্দোবস্ত করে আসেন। বিনিময়ে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব দিল্লির শাসকের চরণতলে বিসর্জন দেয়া হয়। সেই সময় কংগ্রেস ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। হয়ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত সকল জেনারেলরা সেদিন এভাবে দেশের সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দেয়াকে সমর্থন না করলেও তারা কেউ সাহস করে প্রতিরোধ কিংবা প্রতিবাদ করেন নাই। সকল জেনারেলদের সমভাবে অপরাধী সাব্যস্ত না করলেও যে সমস্ত প্রভাবশালী সামরিক কর্তারা ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে ভারতের কাছে দেশের স্বাধীনতা বিকিয়ে দিয়েছিলেন তাদেরকে চিহ্নিত করা আবশ্যক। বিপ্লবী ছাত্র-জনতাকে সতর্ক করে বলছি, দেশদ্রোহীদের চিনতে না পারলে আগস্ট বিপ্লবের সফলতা ধরে রাখা কঠিন হবে। বাংলাদেশের জনগণের স্মৃতি ঝালিয়ে নেয়ার কাজে সহায়তার জন্য সেই সময়ের সেনাবাহিনীর মধ্যকার মূল অপরাধীদের একটা তালিকা দেয়ার চেষ্টা করছি:
১। জেনারেল মইন ইউ আহমেদ
২। লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী
৩। মেজর জেনারেল এ টি এম আমিন
৪। লেফটেন্যান্ট জেনারেল মামুন খালেদ
৫। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারি
সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে যে শেখ হাসিনা, ২০০৯ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ক্ষমতায় আসীন হলেন, তিনিই দুই মাস অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই বিডিআর বিদ্রোহের মোড়কে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলেন। এ যেন আর এক পলাশী। ১৭৫৭ সালের সেই যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলাহ’র প্রধান সেনাপতি মীরজাফর, সেনাপতি রায় দুর্লভ, এবং ইয়ার লতিফ খান দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্লাইভের সাথে হাত মিলিয়েছিল। এবার ২০০৯ সালে দেশবাসী অবাক হয়ে দেখলো যে, দুই দিন ধরে বিডিআর সদর দপ্তরে সেনা কর্মকর্তাদের নির্বিচারে হত্যা এবং তাদের পরিবারের উপর অবর্ণনীয়, বর্বর নির্যাতন চললেও, ভারতীয় দালাল সেনাপ্রধানসহ নপুংসক জেনারেলরা কেবল নিরবে দেখে গেলেন। সেনাবাহিনীর চোখের সামনে, তাপস, নানক, ইনু, মেনন, সাহারা খাতুনরা বিনা বাধায় বিডিআর সদর দপ্তরে যাওয়া-আসা করতে পারলেও, সেনা সদস্যদের জন্য ঐ এলাকা “Out of Bound” হয়ে রইল। সব তারকা খচিত জেনারেলরা কাপুরুষের মত শেখ হাসিনার হুকুম তামিল করে গেলেন এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মর্যাদা ধূলিস্যাৎ হয়ে যেতে ভারতকে সহায়তা করলেন। সেনাপ্রধান জেনারেল মইন সহ তৎকালিন সকল জি ও সি, ডিজিএফআই এর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ এবং সেনা সদর দপ্তরের সকল জেনারেলকে বিডিআর হত্যাকাণ্ডে হয় সহযোগিতা অথবা নিষ্ক্রিয়তার জন্য অভিযুক্ত করতে হবে। নইলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।
বিডিআর বিলুপ্ত করে বিজিবি গঠিত হলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিজিবি প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধীনস্থ: হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের সেনাপ্রধান দিল্লি থেকে মনোনীত হওয়ার প্রথা চালু হয় এবং বাংলাদেশের ক্যান্টনমেন্টসমূহে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা “র” (RAW) এর ব্যাপকহারে অনুপ্রবেশের অভিযোগ উঠতে আরম্ভ করে। জনগণের মধ্যে বিশ্বাস জন্মে যায় যে, ডিজিএফআই এর সদর দপ্তরে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা তাদের বিরাট অফিস খুলে ফেলেছে। সেই অফিসে কর্মরত ভারতীয় গোয়েন্দারা নাকি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসারদের উপর নজরদারি চালাতেন। এই পটভূমিতে ঢাকায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দিল্লির পুতুল সরকারকে অনন্তকাল ধরে ক্ষমতায় বসিয়ে রাখার অভিপ্রায়ে একাধারে তিনটি ভুয়া নির্বাচনের বন্দোবস্ত করা হয়। সেই সব পাতানো নির্বাচনে প্রতিটি সেনাপ্রধান এবং ডিজিএফআই এর কর্তাব্যক্তি ও অন্যান্য প্রভাবশালী কর্মকর্তারা গণবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। আগস্ট বিপ্লবকে সফল করবার জন্য এদের সবাইকে চিনে রাখা আবশ্যক।
১। ২০১৪ সালের “একদলীয়” নির্বাচনকালিন সেনাপ্রধান: জেনারেল ইকবাল করীম ভুঁইয়া
২। ২০১৮ সালের “মধ্যরাতের” নির্বাচনকালিন সেনাপ্রধান: জেনারেল আজিজ আহমেদ
৩। ২০২৪ সালের “ডামি” নির্বাচনকালিন সেনাপ্রধান: জেনারেল শফিউদ্দিন আহমেদ
২০০৯ সাল পরবর্তী ডিজিএফআই প্রধানদের তালিকা যারা শেখ হাসিনার নির্দেশে ভিন্ন মত দমনে আয়নাঘর বানানোসহ সকল প্রকার নৃশংস মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে এবং ভারতের তাবেদারি করেছে:
১। মোল্লা ফজলে আকবর
২। শেখ মামুন খালেদ
৩। মোহাম্মদ আকবর হোসেন
৪। মোহাম্মদ সাইফুল আবেদিন
৫। আহমেদ তাবরেজ শামস চৌধুরী
৬। হামিদুল হক
জনগণের সকল অধিকার হরণ করে বাংলাদেশকে এক নারকীয় রাষ্ট্রে পরিণত করার ক্ষেত্রে উপরোক্ত সেনা কর্মকর্তাগণ প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখে কেবল ফৌজদারি অপরাধই করে নাই, তারা দিল্লির কাছে মাথা বেঁচে দিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহেরও অপরাধী। অবশ্যই এদের সকলের সেনা আইনে রাষ্ট্রদ্রোহ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য সিভিল আইনে বিচার হতে হবে। বিডিআর ম্যাসাকারের পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আর পূর্বের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যে ফিরে যেতে পারে নাই। আগস্ট বিপ্লব সেনাবাহিনীকে তার সতেরো বছরের (২০০৭-২০২৪) পাপ মোচনের একটা সুযোগ করে দিয়েছে। সেই সুযোগ সেনা বাহিনী গ্রহণ করবে কিনা তার জবাব পেতে হলে আমাদেরকে বিপ্লবের চূড়ান্ত পরিণতি দেখা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। উল্লেখ্য, বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ্জামান একটি ভুল ইতিমধ্যে করে ফেলেছেন। আইএসপিআর এর বিবৃতি অনুসারে সেনাবাহিনী প্রায় সাড়ে ছয়শ রাজনীতিবিদ এবং পুলিশ অপরাধীকে আশ্রয় দিয়েছিল যাদের হদিস এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। এই কারণে নানারকম দুর্নীতি এবং অবৈধ আর্থিক লেনদেনের গুজব জনগণ বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছে। এই গুজব নিরসনের দায়িত্ব সেনাবাহিনীকেই নিতে হবে। ক্যান্টনমেন্টে যাদের আশ্রয় দেয়া হয়েছিল তাদের নামের তালিকা এবং বর্তমানে তাদের অবস্থানের বিষয়ে আইএসপিআর এর আর একটি দ্রুত বিবৃতি আমরা আশা করছি। অনেক হয়েছে। দয়া করে সেনাবাহিনীকে আর বিতর্কিত করবেন না।
সর্বোপরি আগ্রাসী ভারত
দানব শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসন প্রায় ষোল বছর দীর্ঘায়িত করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে ভারত। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর উপর দিল্লির একচ্ছত্র প্রভুত্ব বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা নতুন কিছু নয়। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশে ১৯০ বছর ব্যাপী বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হতেই ভারত এই অঞ্চলে প্রভুত্ব কায়েমের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ১৯৪৯ সালে ভুটানের হাতে মোচড় দিয়ে আধিপত্যবাদী দেশটি যে একটি অন্তকালীন প্রভুত্বমূলক চুক্তি সম্পাদন করেছিল তার সঙ্গে হিমালয়ের ক্ষুদ্র রাজ্যটির ১৯১০ সালে সম্পাদিত বৃটিশ হেজেমনিক চুক্তির (পুনাখা চুক্তি) কোন চরিত্রগত পার্থক্য ছিল না। ফলে আজ পর্যন্ত ভুটানকে আধা স্বাধীন দেশের অমর্যাদা নিয়েই টিকে থাকতে হচ্ছে। ভারতের অনিচ্ছার ফলে, জাতিসংঘের পাঁচ সদস্যের (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, এবং ফ্রান্স) মধ্যে কারো সঙ্গেই ভুটানের অদ্যাবধি আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে নাই। উপনিবেশ উত্তর (Post-Colonial) দক্ষিণ এশিয়ায়, সৃষ্টি থেকেই পাকিস্তান তার সামরিক ও অর্থনৈতিক দুর্বলতা সত্ত্বেও, ভারতের আঞ্চলিক প্রভুত্ব কায়েমের স্বপ্ন বাস্তবায়নে যথাসাধ্য বাধা দিয়ে এসেছে। আফগানিস্তানের সাথে ভারতের কোন সীমান্ত না থাকার ফলে সেখানে ভারতের থাবা বিস্তারের প্রচেষ্টা কোন কালেই তেমন ফলপ্রসূ হয় নাই। কখনও রাশিয়া, আবার কখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লেজুড় হয়ে ভারতকে কাবুলে কাজ করতে হয়েছে। নেপাল, শ্রীলংকা এবং মালদ্বীপও ভারতীয় প্রভুত্বকে আজ পর্যন্ত মেনে নেয় নাই। দেশগুলির জনগণ ভারতীয় হেজেমনির বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে লড়াই করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের গল্প অবশ্য অনেকটাই ভিন্ন।
১৯৭১ সালে ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভুত্ব কায়েমের মোক্ষম সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্যই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান করেছিল। এর আগে ১৯৪৭ এবং ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ অমিমাংসিতভাবে শেষ হয়েছিল। কিন্তু, ১৯৭১ এ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ফলে শুধু যে, পাকিস্তান দ্বিখন্ডিত হয়ে হীনবল হয়ে পড়েছিল তাই নয়, ভারতের পূর্ব সীমান্তে সামরিক দিক দিয়ে দুর্বল এবং ভারতের প্রতি নির্ভরশীল ও অনুগত এক নতুন রাষ্ট্র জন্ম নিয়েছিল। দিল্লির নীতিনির্ধারকরা ধারনা করেছিল যে, ধর্মে মুসলমান হলেও, বাংলাদেশের জনগণ যেহেতু পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমান ধর্মাবলম্বী শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে হিন্দু ভারতের সহায়তা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, কাজেই মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও নব্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশটির অধিকাংশ জনগোষ্ঠী ইসলামের প্রতি বিমুখ হয়ে ক্রমেই জীবনাচারে হিন্দু সংস্কৃতি গ্রহণ করবে। অর্থাৎ, আশা ছিল যে, রাজনৈতিকভাবে ও ধর্মীয়ভাবে ভারতের সাথে একেবারে মিশে না গেলেও বাংলাদেশের জনগণ সোৎসাহে সাংস্কৃতিকভাবে হিন্দুত্ববাদের অধীনতা মেনে নেবে। বাঙ্গালী মুসলমানের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং স্বতন্ত্রতা চিরতরে কবর দিতেই হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতি থেকে জন্ম নেয়া তথাকথিত বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ এবং মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য ভারতের প্রতি অনন্তকালের কৃতজ্ঞতার বয়ান তৈরী করে মগজ ধোলাইয়ের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। দিল্লির শাসকরা ধরেই নিয়েছিল যে, শেখ মুজিব সরকারের মাধ্যমে ভুটানের মতই অতি সহজে তারা বাংলাদেশের উপরও এক চিরস্থায়ী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। সেই লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের প্রারম্ভেই বাংলাদেশের সাথে পঁচিশ বছর মেয়াদী এক তথাকথিত “বন্ধুত্ব” চুক্তিও সম্পাদন করা হয়েছিল।
ভারতের আধিপত্যবাদী উদ্দেশ্য বুঝতে বাংলাদেশের জনগণের খুব বেশি সময় লাগে নাই। ভারতের এ দেশীয় এজেন্টদের পাকিস্তানের শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে যুদ্ধকে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রূপান্তরিত করবার অপকৌশল ব্যর্থ হয় এবং ১৯৭৫ সালে, স্বাধীনতা প্রাপ্তির মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই শেখ মুজিবর রহমানের স্বৈরাচারী, এক দলীয় বাকশাল সরকারের রক্তাক্ত পতন ঘটে। এরপর আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফিরতে ২১ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জেতার জন্য শেখ হাসিনাকে তার পিতার স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের জন্য ক্ষমা চাইতে হয়েছিল, একজন অতি ধার্মিক মুসলমানের মুখোশ পড়তে হয়েছিল, এবং তিনি যে ভারতীয় দালাল নন সেটি জনগণকে বারবার বোঝাতে হয়েছিল। এত কিছুর পরও শেখ হাসিনা তৎকালিন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় পাঁচ বছরের বেশি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেন নাই। ২০০১ সালের নির্বাচনে তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ধরাশায়ী হয়েছিল। শেখ হাসিনার এক মেয়াদ (১৯৯৬-২০০১) পরেই বিএনপি ক্ষমতায় ফিরে এলে দিল্লির ডিপ স্টেইট বুঝতে পারল যে, গণতন্ত্র বজায় থাকলে বাংলাদেশের জনগণের উপর দীর্ঘ সময় ধরে প্রভুত্ব করা সম্ভব হবে না। ভারতীয় গোয়েন্দাদের শিকড় বাংলাদেশের সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে বিস্তার ঘটানোর জন্য হাসিনার নেতৃত্বে দিল্লির পুতুল সরকারের একটানা দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেই সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বিলুপ্তির ষড়যন্ত্র করা হয়। সেই ষড়যন্ত্রে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপীল বিভাগের আরো তিন বিচারপতি (মোজাম্মেল হোসেন, এস কে সিনহা, এবং সৈয়দ মাহমুদ হোসেন) মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। সুপ্রীম কোর্টের রায়ে ৪-৩ ভোটে তত্ত্বাবধায়ক প্রথা বাতিল হয়ে গেলে ২০১৩ সালে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কবর রচিত হয়ে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম হয়।
সেই সময় পশ্চিমা বিশ্বে ইসলামোফোবিয়া প্রবল হয়ে উঠেছিল। ভারত এবং শেখ হাসিনা সেই ইসলামোফোবিয়ার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে। বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলমান ধর্মাবলম্বী হলেও কথিত ইসলামী জঙ্গী দমনের নামে ধার্মিক মুসলমান এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে অবর্ণনীয় নিপীড়ন শুরু করে হিন্দুত্ববাদী ভারতের পুতুল, শেখ হাসিনা সরকার। হাজার হাজার নাগরিককে গুম এবং বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়। অসংখ্য মানুষকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। ভারতীয় এজেন্ডা প্রতিপালন করার জন্য একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে তামাশা করে একের পর এক ইসলামপন্থী রাজনৈতিক নেতাদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। দিল্লির প্রশ্রয়ে দানব শেখ হাসিনা জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে দেশকে এক অলিখিত এক দলীয় রাষ্ট্র পরিণত করেন। বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ভারতের সাথে একের পর এক একতরফা চুক্তি সম্পাদন করা হয়। শেখ হাসিনা নিজেই প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন যে, তিনি ভারতকে যা দিয়েছেন সেটা ভারত কোনদিন ভুলতে পারবে না। শেখ হাসিনা দেশের সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিয়ে যেভাবে ভারতের একতরফা স্বার্থ রক্ষা করেছেন তার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা নীচে দেয়া হলো:
১। বিনা শুল্কে অথবা নাম মাত্র শুল্কে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে ভারতকে করিডোর প্রদান
২। বাংলাদেশে ভারতীয় রাডার স্থাপনের অনুমতি প্রদান
৩। বাংলাদেশের বন্দর পরিচালনা এবং সেগুলির ব্যবহারে ভারতকে একচ্ছত্র অধিকার প্রদান
৪। সেনা বাহিনীসহ বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দিল্লির অধীনে সমর্পণ
৫। গঙ্গা ও তিস্তাসহ ৫৪ টি অভিন্ন নদীর উপর আন্তর্জাতিক আইনে ভাটির দেশ বাংলাদেশের অধিকার ভারতের কাছে বিসর্জন
৬। বাংলাদেশকে ভারতের বাজারে পরিণতকরণ
৭। বাংলাদেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর চাকুরীর বাজার সংকুচিত করে ভারতীয় নাগরিকদের এ দেশে চাকুরীর অবারিত সুযোগ প্রদান
৮। নরেন্দ্র মোদীকে সন্তুষ্ট করার জন্য ভারতের আদানি শিল্পগোষ্ঠীর কাছ থেকে অত উচ্চ মূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয়
৯। সীমান্তে বাংলাদেশের নাগরিক হত্যায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফকে নিরব সম্মতি প্রদান
১০। ভারতের আদলে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার হিন্দুত্বকরণ
১১। বাংলাদেশের প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা “র” এর অনুপ্রবেশের অবারিত সুযোগ প্রদান
পুতুল শেখ হাসিনাকে জনগণের কোনরকম ম্যান্ডেট ছাড়াই অব্যাহতভাবে ক্ষমতায় রাখার জন্য ভারত সারা বিশ্বে ওকালতির দায়িত্ব গ্রহণ করে। ফলে একের পর এক ভুয়া নির্বাচন করলেও ২০২১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারকে কোন আন্তর্জাতিক বাধানিষেধের মুখে পড়তে হয় নাই। সেই বছর ডিসেম্বরে প্রথম বারের মত মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পুলিশ প্রধান, সেনা প্রধান, গুটিকয়েক সামরিক কর্মকর্তা এবং র্যাবের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করে। এতে অবশ্য ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির আরো একটি “ডামি নির্বাচন” ঠেকানো যায় নাই। কারণ, ওয়াশিংটনসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশের রাজধানীতে শক্তিশালী ভারতীয় এবং ইসরায়েলি লবি বাংলাদেশে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনে নীরব সম্মতি প্রদানের জন্য চাপ দিয়ে সফল হয়।
বাংলাদেশে ভারতীয় গোয়েন্দাদের বিপুল উপস্থিতি সত্ত্বেও তারা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ এবং জনরোষের মাত্রা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে। অবশেষে আগস্ট বিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনাকে তার প্রভুদেশ ভারতেই আশ্রয় নিতে হয়েছে। ১৯৮১ সালে পুরনো বাসস্থান দিল্লি থেকে বাংলাদেশে এসে দুই দফায় ২১ বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে ইতিহাসের অমোঘ বিচারে দেশদ্রোহী শেখ হাসিনাকে অবমাননাকরভাবে পালিয়ে ৪৩ বছর বাদে দিল্লিতেই আশ্রয় নিতে হয়েছে। শেখ হাসিনা নামক দানবের উত্থানে ভারতের ভূমিকা বর্তমানে সারা বিশ্বে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতীয় মিডিয়া এবং সে দেশের সুশীল সমাজ এতোদিন অন্ধভাবে হাসিনার ফ্যাসিবাদকে সমর্থন দিয়ে গেলেও এখন খানিকটা মুখ খুলতে শুরু করেছে। ভারত সরকারকেও বাংলাদেশে ভয়াবহ কূটনৈতিক বিপর্যয়ের পর নতুন পরিস্থিতিতে আঞ্চলিক ভূরাজনীতি নিয়ে নতুন কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। ঢাকার লজ্জাকর পরাজয়ের পর দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতীয় দাদাগিরি আর চলবে কিনা সেটা এখন বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন।
লেখক :
মাহমুদুর রহমান
সম্পাদক, আমার দেশ