বাংলাদেশী না কি বাঙালি – প্রথমে এই দুটো শব্দের তফাৎটা বুঝতে হবে।
বাঙালি একটা ভাষাভিত্তিক (ethnolinguistic) জাতিগত পরিচয়। ভারতীয় উপমহাদেশের জাতিগত গোষ্ঠীভেদ হয় মাতৃভাষা অনুযায়ী। তো যাদের মাতৃভাষা বাংলা, সারা পৃথিবীর যেই প্রান্তেই থাকুক না কেন তারা বাঙালি তবে তাদের সবাই বাংলদেশী নয়। আবার বাংলাদেশের যে সব উপজাতি লোকজন (চাকমা কুকি ম্রো ইত্যাদি) আছে তারা কিন্তু আবার বাঙালি নন (যেহেতু তাদের মাতৃভাষা বাংলা নয়) তবে তারা বাংলাদেশী।
এবার আসি ভারতীয় বাংলা বাংলাভাষী এবং বাংলাদেশের বাংলাভাষীদের বিষয়ে। ভারতে বসবাসকরি বাংলাভাষীরা সবসমই চেয়েছে এবং চাচ্ছে ভারতীয় মাহাজাতির অংশ হয়ে বাঁচতে। কিন্তু এর বিপরীত অবস্থানে বাংলাদেশের বাংলাভাষীদের। বাংলাভাষায় যত লোক কথা বলেন তার মধ্যে প্রায় ৬০ ভাগ বাস করেন বর্তমান বাংলাদেশে। আর শতকরা ৪০ ভাগ বাস করে ভারতে। এই ৪০ ভাগ চাচ্ছেন ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করতে; বাঙালি জাতীয়তাবাদকে নয়।
শেখ মুজিব সাবেক পাকিস্তানের রাষ্ট্রিক কাঠামোর মধ্যে থেকেই বলেছিলেন, বাঙালিদের স্বার্থ সংরক্ষণের কথা , তার স্লোগানই ছিল ‘জয় বাংলা’। উঠিয়েছিলেন ছয়দফার দাবি। তার সেই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের মধ্যেই নিহিত মুজিব কিভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যে থেকেই একটি বাঙালি জাতির স্বার্থ সংরক্ষণের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু ঘটনা পরম্পরায় সৃষ্টি হয়ে যায় পৃথক স্বাধীন বাংলাদেশ। আর সেই দেশ সৃষ্টির সাথে সাথেই বদলে যায় এর জাতিসত্ত্বার রূপ।
স্বাধীন হয় সেই নতুন দেশের জাতিসত্ত্বার রূপ শেখ মুজিব অনুধাবন করতে না পারলেও, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এটা উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন। তিনি তাই গ্রহণ করেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ধারণা। আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদকে আঁকড়ে ধরে থাকলেও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিশ্বাস করে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ।
১৯৭৬ সালের ৩ রা মার্চ জিয়া প্রথম সামনে নিয়ে আসেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের কথা। তিনি ১৯৭৭ সালের ২৫ শে অক্টোবর বঙ্গভবনে শিল্পী সাহিত্যিক সমাবেশে বলেন যে, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদই হতে হবে আমাদের শিল্প-সাহিত্যের প্রেরণা; বাঙালি জাতীয়তাবাদ নয়। জিয়ার এই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে ব্যাখা করতে গেলে বলতে হয়, এর ভিত্তি হলো বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমানা, এর বাংলাভাষী জনসমাজ এবং এই জনগোষ্ঠীর সতন্ত্র পরিচিতির আকাঙ্খা।
আমাদের বুঝতে হবে ভাষা জাতীয়তাবাদের একটি মৌলিক উপাদান। কিন্তু একমাত্র উপাদান নয়। ভাষার সাথে সাথে ভৌগলিক সীমানা, জনগোষ্ঠীর রীতিনীতি , ধর্ম , বিশ্বাস মিলেই তৈরী হয় একটা জাতীয়তাবোধের ক্ষেত্র। আর সেই সব কিছুর সম্বন্বয়েই বাস্তবতার ভিত্তিতেই আজ আমরা বাংলাদেশী।