পরিমার্জন , পরিবর্তন , পরিবর্ধন – এর যেকোনো একটাই যেমন সংস্কার , তেমনি এর সবগুলো একসাথে ঘটলেও সেটাও সংস্কার। এখন প্রশ্ন আমরা কোন সংস্কার চাই ? আপনি যে সংস্কার চাচ্ছেন আপনার পাশের ভদ্রলোকটি হয়তো সেটা চাচ্ছেন না। আবার তিনি যেটাকে সংস্কার হিসাবে মনে করছেন আপনার কাছে হয়তো তার কোনো মূল্যই নেই। তাই প্রথমে আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি কেমন সংস্কার চান- আর সেই সংস্কার আগে নিজের মধ্যেই ধারণ করতে হবে। সংস্কারের শুরুটা হতে হবে ব্যক্তি পর্যায়ে। ব্যক্তি পর্যায়ে আপনি যদি সংস্কারের সূচনা করতে পারেন তবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব সেই সংস্কারকে ধারণ করা। আর রাষ্ট্র যদি তা ধারণ করতে ব্যর্থ হয় তবে তাকে ছুড়ে ফেলে নতুন করে গড়তে হবে। আর অন্যদিকে রাষ্ট্র যদি কোনো সংস্কারকে চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করে তবে সেই সংস্কার হবে শুধুই খাতাকলমে।
সংস্কার শব্দটা ইদানিং মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ালেও এটা কিন্তু নতুন কোনো কনসেপ্ট না। যুগে যুগে বিভিন্ন দেশে দেশে সংস্কার বিভিন্ন ভাবেই হয়েছে। “রাষ্ট্র সংস্কার” এই কথাকার সাথে আমার প্রথম পরিচয় আশির দশকে / নব্বইয়ের দশকে , তখন মনে হয় মেট্রিকের গন্ডিও পার হতে পারিনি। যতদূর মনে পরে এই শব্দটার সাথে প্রথম পরিচয় ঘটে বাম ঘরনার কিছু বড় ভাইদের মাধ্যমে। তাদের মুখেই ঘন ঘন শুনতাম “রাষ্ট্র সংস্কার” ছাড়া দেশ এগিয়ে যেতে পারবে না। “রাষ্ট্র সংস্কার” জিনিসটা কি তখন ভালোভাবে বুঝতে না পারলেও, শুনতে শুনতে কথাটা বেশ বিশ্বাস যোগ্য বলেই মনে হতো। এরপর যখন মেডিকেল কলেজে আসলাম, ঠিক জানিনা কেন যেন এই “রাষ্ট্র সংস্কার” কথাটা আর তেমন শুনতে পেতাম না। হয়তো সেই বাম বড়োভাইরা তখনও এই নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন – কিন্তু মেডিকেলের পড়াশুনার চাপে আমি হয়তো আর সেই স্বপ্নের ভাগিদার ছিলাম না। আর পরবর্তীতে যখন আমাদের বিপ্লবী (!!) মেনন সাহেব, ইনু সাহেবরা ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট ভোগী হয়ে উঠলেন তখন আর সেই “রাষ্ট্র সংস্কার” কথাটা আর তেমন শুনতে পেতাম না। সাকি ভাই বা মুজাহিদ সাহেবরা কিছুটা বলার চেষ্টা চালালেও তাদের ভাষা বোঝার ক্ষমতা বাংলাদেশের মানুষের কতটুকু ছিল বা তাদের কথা কতজনের কাছে পৌঁছাতে পেরেছিলো তা নিয়ে তারাও সন্দিহান ছিল বলে মনে হয়। যাই হোক এর পর অনেকগুলো বছর পেরিয়ে যাবার পর আবারো নতুন করে “সংস্কার” কথাটা পত্রিকা আর ফেসবুকের পাতায় পাতায় ঘুরতে থাকে গত বছর বিএনপি’র দেওয়া ৩১ দফা “সংস্কার” প্রস্তাবের পর। তবে ২৮শে অক্টোবরের পর তাও প্রায় হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। এরপর পেরিয়ে যায় বেশ কয়েক মাস। শুরু হয় বৈষম্য বিরোধী কোটা আন্দোলন। শুরুতে এই আন্দোলন শুধুমাত্র কোটা প্রথায় সীমাবদ্ধ থাকলেও সময়ের সাথে সাথে তা পরিবর্তিত হয় এবং আন্দোলনের একদম শেষ মুহূর্তে তা অনেকটাই “রাষ্ট্র সংস্কার” আন্দোলনে রূপ নেয়। যদিও হালে রাজনীতিবিদ হতে চাওয়া কিছু কিছু বাচ্চাদের মনে হতেই পারে “সংস্কার” তাদের উদ্ভাবিত একটা শব্দ। অন্তত তাদের মনে কি আছে জানিনা, তবে তাদের কথা বার্তায় তেমনটাই প্রকাশ পায়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বয়স একমাসের বেশি হলেও এখন পর্যন্ত আমরা যেমন তাদের কাছ থেকে পাইনি সংস্কারএর কোনো রূপরেখা তেমনি ছাত্র জনতার এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া সমন্বয়কদের পক্ষ থেকেও আসেনি কোনো গঠনমূলক সংস্কারের দাবি। সংস্কার কথাটা শুধুমাত্র মুখে মুখেই ঘুরে বেড়ায়, তার জন্য নেই কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। তবে এর ব্যাতিক্রম বিএনপি। তারা অন্তত নির্দিষ্ট ভাবে জানাতে পেরেছে তারা কিসের সংস্কার চান বা তারা ক্ষমতায় গেলে কিসের সংস্কার করবে।
আসুন এবার দেখে নেই ২০২৩ সালের জুলাই ১৩ তে প্রকাশিত বিএনপি এবং তার সমমনা দলগুলোর সেই ৩১ দফায় কি ছিল বা আছে :
১. প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে সকল মত ও পথের সমন্বয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক “রেইনবো নেশন” প্রতিষ্ঠা করা হবে। এজন্য অব্যাহত আলোচনা, মতবিনিময় ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎমুখী এক নতুন ধারার সামাজিক চুক্তিতে পৌঁছাতে হবে। এজন্য একটি “ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন কমিশন” গঠন করা হবে।
২. বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় এবং স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে স্থায়ী সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে একটি “নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার” ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে।
৩.সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা হবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচারবিভাগের ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্যের সুসমন্বয় করা হইবে।
৪.পরপর দুই টার্মের অতিরিক্ত কেউ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না।
৫. বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের সমন্বয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার লক্ষ্যে দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সংসদে “উচ্চ-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা ” করা হবে।
৬.আস্থাভোট, অর্থবিল, সংবিধান সংশোধনী বিল এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত এমন সব বিষয় ব্যতীত অন্যসব বিষয়ে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রদানের সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করার বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর (দেখা হইবে) বিবেচনা করা হবে।
৭.রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত এবং বিশিষ্টজনের অভিমতের ভিত্তিতে স্বাধীন, দক্ষ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও দৃঢ়চিত্ত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি কার্যকর নির্বাচন কমিশন গঠন করার লক্ষ্যে বর্তমান “প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২” সংশোধন করা হবে। ইভিএম নয়, সকল কেন্দ্রে পেপার-ব্যালটের মাধ্যমে ভোট প্রদান নিশ্চিত করা হবে। রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইন সংস্কার করা হবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বাতিল করা হবে।
৮. সংকীর্ণ রাজনৈতিক দলীয়করণের ঊর্ধ্বে উঠে সকল রাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে এসকল প্রতিষ্ঠান আইনি সংস্কারের মাধ্যমে পুনঃগঠন করা হবে। শুনানির মাধ্যমে সংসদীয় কমিটির ভোটিং সাপেক্ষে এসকল প্রতিষ্ঠানের সাংবিধানিক ও গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে নিয়োগ প্রদান করা হবে।
৯. সংবিধান ও মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে বিচার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে। বর্তমান বিচারব্যবস্থার সংস্কারের জন্য একটি “জুডিশিয়াল কমিশন” গঠন করা হবে। অধস্তন আদালতসমূহের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধানের কর্তৃত্ব সুপ্রিম কোর্টের নিকট ন্যস্ত হবে। বিচার বিভাগের জন্য সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি পৃথক সচিবালয় থাকবে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অভিশংসন প্রশ্নে সংবিধানে বর্ণিত ইতঃপূর্বেকার “সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল”ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা হবে। এজন্য সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনয়ন করা হবে। দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে কেবলমাত্র জ্ঞান, প্রজ্ঞা, নীতিবোধ, বিচারবোধ ও সুনামের কঠোর মানদণ্ডে যাচাই করে বিচারক নিয়োগ করা হবে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগের লক্ষ্যে সংবিধানের ৯৫(গ) অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা ও মানদণ্ড সম্বলিত “বিচারপতি নিয়োগ আইন” প্রণয়ন করা হবে।
১০.দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ পরিষেবা, জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন গড়ে তোলার লক্ষ্যে যোগ্য, অভিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি “প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন” গঠন করে প্রশাসন সংস্কার ও পুনঃগঠন করা হবে। মেধা, সততা, সৃজনশীলতা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ বেসামরিক ও সামরিক প্রশাসনে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে যোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি হিসাবে বিবেচনা করা হবে।
১১. গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চয়তা বিধান ও সার্বিক সংস্কারের লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি, মিডিয়া সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী এবং বিজ্ঞ, অভিজ্ঞ ও গ্রহণযোগ্য মিডিয়া ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি “মিডিয়া কমিশন” গঠন করা হবে। সৎ ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিবেশ পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে; এই লক্ষ্যে আইসিটি অ্যাক্ট ২০০৬, সন্ত্রাস বিরোধী আইন ২০০৯ এর প্রয়োজনীয় সংশোধন ও স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট – ১৯৭৪, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট -২০১৮ সহ মৌলিক মানবাধিকার হরণকারী সকল কালাকানুন বাতিল করা হবে। চাঞ্চল্যকর সাগর-রুনি হত্যাসহ সকল সাংবাদিক নির্যাতন ও হত্যার বিচার নিশ্চিত করা হবে।
১২.দুর্নীতির ক্ষেত্রে কোনো আপস করা হবে না। বিগত দেড় দশকব্যাপী সংগঠিত অর্থপাচার ও দুর্নীতির অনুসন্ধান করে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা এবং শ্বেতপত্রে চিহ্নিত দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। দেশের বাইরে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনার প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে। দুর্নীতি দমন কমিশন ও দুর্নীতি দমন আইন সংস্কারের পাশাপাশি পদ্ধতিগত সংস্কারের মাধ্যমে ‘দুদকের’ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে। সংবিধান অনুযায়ী “ন্যায়পাল ” নিয়োগ করা হবে।
১৩.সর্বস্তরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা হবে। মানবিক মূল্যবোধ ও মানুষের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং অমানবিক নিষ্ঠুর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অবসান ঘটানো হবে। গত দেড় দশক যাবত সংগঠিত সকল বিচারবহির্ভূত হত্যা, ক্রসফায়ারের নামে নির্বিচারে হত্যা, গুম, খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, নির্মম শারীরিক নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর ও অমানবিক অপরাধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সকল ব্যক্তিকে প্রচলিত আইন অনুযায়ী সুবিচার নিশ্চিত করা হবে।
১৪.অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ ও গবেষক, অভিজ্ঞ ব্যাংকার, কর্পোরেট নেতা, প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি “অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন” গঠন করা হবে।
১৫.“ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার” এই মূলনীতির ভিত্তিতে প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী নিজ নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ অধিকার ভোগ করবেন। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ঘর-বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, উপাসনালয় ভাঙচুর এবং তাদের সম্পত্তি দখলের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
১৬.মুদ্রাস্ফীতির আলোকে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা হবে। শিশু-শ্রম বন্ধ করে তাদের জীবন বিকাশের উপযোগী পরিবেশ ও ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও গণতান্ত্রিক ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিত করা হবে। পাটকল, বস্ত্রকল, চিনিকলসহ সকল বন্ধ শিল্প পুনরায় চালুর উদ্যোগ নেওয়া হবে। প্রবাসী শ্রমিকদের জীবন, মর্যাদা ও কর্মের নিরাপত্তা এবং দেশে বিমানবন্দরসহ সকল ক্ষেত্রে হয়রানি মুক্ত সেবা প্রাপ্তি ও ভোটাধিকার নিশ্চিতের ব্যবস্থা করা হবে। চা-বাগান, বস্তি, চরাঞ্চল, হাওড়-বাওর ও মঙ্গাপীড়িত ও উপকূলীয় অঞ্চলের বৈষম্য দূরীকরণ ও সুষম উন্নয়নে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে।
১৭.বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ খাতে দায়মুক্তি আইনসহ সব কালাকানুন বাতিল করা হবে। রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ রোধ করার লক্ষ্যে জনস্বার্থবিরোধী কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ে চলমান সীমাহীন দুর্নীতি বন্ধ করা হবে। আমদানি নির্ভরতা পরিহার করে নবায়নযোগ্য ও মিশ্র এনার্জি-নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং উপেক্ষিত গ্যাস ও খনিজ সম্পদ আবিষ্কার ও আহরণে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
১৮.বৈদেশিক সম্পর্কের সর্বক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া হবে। সমতা, ন্যায্যতা, পারস্পরিক স্বার্থের স্বীকৃতি ও স্বীকৃত আন্তর্জাতিক বিধি-বিধান অনুযায়ী দ্বিপাক্ষিক ও বহু-পাক্ষিক সমস্যাদির সমাধান করা হবে। বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মধ্যে কোনো প্রকার সন্ত্রাসী তৎপরতা বরদাশত করা হবে না। কোন সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা আশ্রয়-প্রশ্রয় পাবে না। সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
১৯.দেশের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সুসংগঠিত, যুগোপযোগী এবং সর্বোচ্চ দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত করে গড়ে তোলা হবে। স্বকীয় মর্যাদা বহাল রেখে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা হবে।
২০.ক্ষমতার ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিকতর স্বাধীন, শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান করা হবে। স্থানীয় প্রশাসন ও অন্য কোনো জনপ্রতিনিধির খবরদারি মুক্ত স্বাধীন স্থানীয় সরকার নিশ্চিত করা হবে। মৃত্যুজনিত কারণ কিংবা আদালতের আদেশে পদশূন্য না হলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে সরকারি প্রশাসক নিয়োগ করা হবে না। আদালত কর্তৃক দণ্ডপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নির্বাহী আদেশবলে সাসপেন্ড/বরখাস্ত/অপসারণ করা হবে না।
২১. ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে যার যার অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নিবিড় জরিপের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের একটি তালিকা প্রণয়ন করা হবে এবং তাদের যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রদান করা হবে। এই তালিকার ভিত্তিতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কল্যাণার্থে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাই করে একটি সঠিক তালিকা প্রস্তুত করা হবে।
২২.সমাজের ভিশন, চিন্তা ও আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে আধুনিক ও যুগোপযোগী যুব-উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। এক বছরব্যাপী অথবা কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত, যেটাই আগে হবে, শিক্ষিত বেকারদের বেকার ভাতা প্রদান করা হবে। বেকারত্ব দূরীকরণের লক্ষ্যে নানামুখী বাস্তবসম্মত কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী- সরকারি চাকুরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি বিবেচনা করা হবে।
২৩.জাতীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় নারীর কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নারীর ক্ষমতায়নে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। জাতীয় সংসদে মনোনয়নের ক্ষেত্রে নীতিগতভাবে নারীদের প্রাধান্য দেওয়া হবে।
২৪.বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান নৈরাজ্য দূর করে নিম্ন ও মধ্য পর্যায়ে চাহিদা-ভিত্তিক শিক্ষা এবং উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। গবেষণায় বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হবে। যোগ্য, দক্ষ ও মানবিক জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার লক্ষ্যে জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে জিডিপির ৫% অর্থ বরাদ্দ করা হবে। ক্রমান্বয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হবে।
২৫.স্বাস্থ্যকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করে “সবার জন্য স্বাস্থ্য” ও “বিনা চিকিৎসায় কোনো মৃত্যু নয়” এই নীতির ভিত্তিতে যুক্তরাজ্যের ‘এনএইচএস’ এর আদলে সর্বজনীন ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
২৬.স্বাস্থ্যসেবা (ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ) প্রবর্তন করে সবার জন্য স্বাস্থ্য কার্ড চালু করা হবে। বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ৫% অর্থ বরাদ্দ করা হবে।
২৭.কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা হবে। পর্যায়ক্রমে সকল ইউনিয়নে কৃষিপণ্যের জন্য সরকারি ক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে হলেও শস্য বীমা, পশু বীমা, মৎস্য বীমা এবং পোল্ট্রি বীমা চালু করা হবে।
২৮. দেশের যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে সড়ক, রেল ও নৌপথের প্রয়োজনীয় সংস্কার করে সারাদেশে সমন্বিত বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। দেশের সমুদ্র বন্দর ও নৌবন্দরগুলোকে আধুনিকায়ন ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা হবে।
২৯. জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট ও ক্ষতি মোকাবিলায় টেকসই ও কার্যকর কর্মকৌশল গ্রহণ করা হবে। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ও ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সর্বাধুনিক ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ করে রাখা হবে।
৩০.তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তিখাতকে বৈশ্বিক মানে উন্নীত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। মহাকাশ গবেষণা এবং আণবিক শক্তি কমিশনের কার্যক্রমের প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রায়োগিক সুযোগ সমৃদ্ধ করা হবে।
৩১. এক জাতীয় মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে শহরে ও গ্রামে কৃষি জমি নষ্ট না করে এবং নগরে জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপ হ্রাস করে পরিকল্পিত আবাসন ও নগরায়নের নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে। পর্যায়ক্রমে দেশের সব দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আবাসন নিশ্চিত করা হবে।
অনেকেই হয়তো তাদের এই সংস্কার পরিকল্পনার সাথে একমত নাও হতে পারেন, তবে মোটা দাগে এর কোনোটির সাথেই দ্বিমত করার তেমন কোনো কারণ খুঁজে বের করা কষ্টসাধ্য। শুঘুমাত্র বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করার মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসলে তাদের এই সংস্কার পরিকল্পনা হতে পারে এক ধরণের গাইড লাইন। এই ৩১ দফাকে পরিমার্জন , পরিবর্তন , পরিবর্ধন করেই একটি অর্থপূর্ণ সংস্কারের রূপরেখা প্রণয়ন করা খুব কষ্টসাধ্য কোনো কাজ হবার কোনো কারণ দেখিনা।
এখন প্রশ্ন আপনি কি সত্যি “সংস্কার” চান? যদি চান , তবে কি সেই “সংস্কার”। আপনি নিজে কি প্রস্তুত নিজেকে সেই ভাবে “সংস্কার” করতে? আপনি যদি নিজেকে “সংস্কার” করতে পারেন শুধুমাত্র তা হলেই আপনি রাষ্ট্রের কাছে সেই “সংস্কার” আশা করতে পারেন। কারণ সংস্কারের শুরুটা হতে হবে আপনার কাছ থেকেই। শুধু মাত্র আইন করে অথবা কিছু পদ পরিবর্তনে করে “সংস্কার” হয়- অন্তত সেই “সংস্কার” টেকসই হয় না।