অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস পরও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারছে না দেশ। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালানোর প্রেক্ষিতে শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে বলে আশা ছিল সাধারণ মানুষের। তবে সে প্রত্যাশা পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়ায় একের পর এক আন্দোলন। যৌক্তিক-অযৌক্তিক নানা আন্দোলনে অনেকটাই দিশেহারা অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকার। দাবি-দাওয়া, হাহাকার তুলে মাঠে স্বার্থান্বেষী নানা গোষ্ঠী। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তারা সক্রিয়। যারপর নাই চাপ তৈরি করছে নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। এখনই তাদের সবার সব দাবি পূরণ করতে হবে। দাবি-দাওয়া পার্টির কারণে দেশ জুড়ে যখন তখন সড়কে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি
তৈরি হচ্ছে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অভ্যুত্থানের ফ্রন্টলাইনার তরুণ ছাত্রদের আন্তঃক্যাম্পাস কলহ। এটা এক নৈরাজ্যকর অবস্থার জানান দিচ্ছে।
কখনো শিক্ষার্থী, কখনো আনসার, কখনো প্যাডেলচালিত রিকশাচালক, কখনো ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক, গার্মেন্ট শ্রমিক, চিকিৎসক-নার্স, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের চাকরিজীবী, নাট্যকর্মীসহ পেশাজীবীরা প্রতিনিয়ত আন্দোলনে উত্তাল রাখছেন রাজধানী। নানা দাবিকে ঘিরে কমবেশি প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে খন্ড খন্ড আন্দোলন। কখনো কখনো তা সহিংস আন্দোলনে রূপ নিচ্ছে। নানান ইস্যুতে প্রায় প্রতিদিনই রাজপথ বন্ধ করে কোনো না কোনো দাবি আদায়ের আন্দোলন হচ্ছে। এতে জনজীবনে স্বস্তি ফিরছে না আর দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
বিশ্লেষকদের মতে, যে কেউ যেকোনো দাবিতে আন্দোলন করলেই সরকারকে নমনীয় হতে দেখা যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে দুর্বল দাবিকেও মেনে নেওয়া হচ্ছে। যা নতুন নতুন আন্দোলন তৈরি হতে ইন্ধন জোগাচ্ছে। আবার সেই সাথে যুক্ত হচ্ছে পতিত হাসিনা সরকারের মদদ আর এতে পরিস্থিতি দিন দিন ঘোলাটে হচ্ছে।
নতুন নতুন দাবিতে আন্দোলন সৃষ্টি হওয়াকে সরকারের দাবি মেনে নেওয়ার মানসিকতা যেমন ভাবে দায়ী ঠিক তেমন ভাবে এই সব আন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে হাসিনার দোসরদের মদদও তেমন ভাবেই দায়ী বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।
এই সরকার ক্ষমতা গ্রহণের শুরুতেই আন্দোলনের মুখে এইচএসসি ও সমমানের স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিল করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় দাবি মেনে নেবার সেই ধারা। এরপর চাকরিতে ৩৫ বয়স প্রত্যাশীরা দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন করে আসছেন। তাদের দাবি অযৌক্তিক বলে বিগত সরকার কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আটঘাট বেঁধে নামেন তারা। তারা ধরেই নেন এবার দাবি পূরণ হবেই। পরবর্তী সময়ে সরকার এক পর্যায়ে তাদের দাবি মেনেও নেয়। যদিও আলোচনা, পর্যালোচনা শেষে সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩২ চূড়ান্ত করা হয়। যা আগে ছিল ৩০ বছর। এই দাবি মেনে নেওয়াকেও অনেকে দুর্বলতা বলেছেন।
সম্প্রতি ঢাবি অধিভুক্ত সাতটি কলেজ যুক্ত করে ‘কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনে নামেন একদল শিক্ষার্থী। তাদের টানা আন্দোলনে রাজধানীতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। তার মধ্যে আবার তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে মাঠে নামেন তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা। যাত্রীবাহী ট্রেনে ঢিল ছুড়ে আহত করেন শিশুসহ অনেক যাত্রীকে। এছাড়া ঢাকা কলেজ এবং সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় ধাওয়া-পালটা ধাওয়ার ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজকে ঘিরে রণক্ষেত্র তৈরি হয়েছে যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া এলাকায়। এসব প্রতিটি ঘটনার পিছনে ছিল গত সরকারের সমর্থন পুষ্ট একটি স্বার্থনেষী গ্রুপের মদদ বলেই মনে করছেন অনেকে।
কয়েকদিন ধরে ব্যাটারিচালিত অটো রিকশাচালক ও মালিকরা বিভিন্ন দাবি আদায়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ ও সমাবেশ করছেন। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে যান তারা। পরে পুলিশ প্রশাসনের আশ্বাসে গণ-অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত করে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, ভ্যান ও ইজিবাইক শ্রমিক ইউনিয়ন। তবে এই ঘটনাতেও দেখা মেলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হাত।
শুধু তাই নয়, ঢাকায় বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন, ওয়াসা, ডেসা, সচিবালয় কর্মচারী থেকে বিভিন্ন সরকারি, আধা-সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও তাদের দাবি নিয়ে মাঠে আছেন।
এর মধ্যেই আবার সামনে আসে ইসকন ইস্যু। দেশের ভিতরের একটি গোষ্ঠী আর ভারতের মদদেই ইসকনের ব্যানারে রাস্তায় নেমে আসে মূলত আওয়ামীলীগের ক্যাডাররা। এতে ইতিমধ্যেই জীবন হারিয়েছেন একজন আইনজীবী।
বিতাড়িত স্বৈরাচারের পলায়নের পর গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে একদিকে দীর্ঘ দেড় দশক ধরে অধিকার বঞ্চিত মানুষের চাওয়া পাওয়ার হিসেব অপরদিকে পলাতক স্বৈরাচারের প্রতিশোধের আগুন – সবমিলিয়ে দেশে এক ঘোলাটে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। অবৈধ ক্ষমতা আর অবৈধ সুবিধা হারানো পলাতক স্বৈরাচারের দোসররা সরকারকে অস্থিতিশীল করতে জনগণের দাবি আদায়ের নানা আন্দোলনকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে। আন্দোলনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মিশে গিয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির করছে।
এখনই শক্ত হাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সামনে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে বলেই মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।