সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশনের সংস্কারে ৬ টি কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বুধবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে তিনি এই ঘোষণা দেন। ভাষণে তিনি বলেন, এসব কমিশনের কাজ পরিচালনার জন্য বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে ছয়জন বিশিষ্ট নাগরিককেএই কমিশনগুলি পরিচালিনা করার দায়িত্ব দিয়েছি।
দায়িত্ব পাওয়া ছয় বিশিষ্ট নাগরিকের পরিচয় :
বদিউল আলম মজুমদার:
অর্থনীতিবিদ, উন্নয়নকর্মী, রাজনীতি বিশ্লেষক, স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ। নাগরিক সংগঠন ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। তিনি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দাতব্য সংস্থা ‘দি হাঙ্গার প্রজেক্ট’-এর বাংলাদেশি শাখার পরিচালক ও বৈশ্বিক সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তিনি বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমীর (বার্ড) বোর্ড অব গভর্নরস্-এর একজন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের উপদেষ্টা পরিষদের একজন সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ড. বদিউল আলম মজুমদার
তার ব্যাপারে এখনো বিস্তারিত কোনো কিছু জানা যায় নি।
সফর রাজ হোসেন:
পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে কাজ করবেন সফর রাজ হোসেন। সাবেক স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন সচিব। উল্লেখ্য, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেয়া ভাষণে পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধানের নামের ভুল বানান লেখা হয়েছিল সরফরাজ চৌধুরী। পরবর্তীতে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে দেয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে তা সংশোধন করা হয়।
তার সাথে আওয়ামীলীগের চট্টগ্রাম জেলা উত্তরের উপদেষ্টা ও অবসরপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. সরফরাজ খান চৌধুরী বাবুলকে মিলিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু পোস্ট দেখা যাচ্ছে।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের দায়িত্ব একজন ডাক্তারকে দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সরফরাজ চৌধুরী সম্পর্কে বিস্তারিত জানা গেলে পরবর্তীতে পোস্ট করা হবে।
তবে সোস্যাল মিডিয়াতে তার নামে যা ঘুরে বেড়াচ্ছে তা হলো
নাম এসেছে সরফরাজ চৌধুরী, পুরো নাম- ডা. সরফরাজ খান চৌধুরী বাবুল। তিনি সাবেক ছাত্রলীগ নেতা, অবসরপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য। তিনি চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৯ কোটি ১৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় ২০২২ সালে জেলে যান । পরবর্তীতে সাবেক এই ছাত্রলীগ নেতা, পঁচাত্তরে শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের অন্যতম প্রতিবাদকারী ডা. সরফরাজ খান চৌধুরীকে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য মনোনীত করা হয়। ঠিক কোন যোগ্যতা বলে তাকে পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তা এখনো জানা যায়নি।
বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান:
বিএনপির প্রয়াত নেতা আ স ম হান্নান শাহর ভাই মোমিনুর রহমান ১৯৮০ সালে রহমান বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী হন এবং ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন।
২০০৭ সালের অক্টোবরে রহমান ও বিচারপতি যুবায়ের রহমান চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জামিন আদেশ জারি করেন। ২২ নভেম্বর ২০০৭ সালে রহমান এবং বিচারপতি যুবায়ের রহমান চৌধুরী দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পদের বিবরণী চাওয়াকে অবৈধ ঘোষণা করেন।
২৭ জানুয়ারী ২০০৮ সালো রহমান ও বিচারপতি শহীদুল ইসলাম তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে কেন স্থগিত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্দেশ দেওয়া হবে তা জানতে চেয়ে একটি আদেশ জারি করেন। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি এবং বিচারপতি শহিদুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আজম জে চৌধুরীর করা মামলার কার্যক্রমকে অবৈধ ঘোষণা করেন। ১৭ মার্চ ২০০৮ সালে প্রধান বিচারপতি তাকে বিচারিক ক্ষমতা থেকে কেড়ে নেন।
২০০৯ সালে রহমানকে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারক করা হয়।
আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ২০১১ সালে প্রথমে তাকে ডিঙিয়ে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি, পরে আবার তাকে ডিঙিয়ে বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনকে প্রধান বিচারপতি করা হলে তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান
ড. ইফতেখারুজ্জামান
ইফতেখারুজ্জামান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক। দুর্নীতি নিয়ে সরকারের সমালোচার পরিচিত মুখ ড. ইফতেখারুজ্জামান ১৯৯১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ছিলেন। ইফতেখারুজ্জামান ২০০৮, ২০১২ এবং ২০১৫ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক পরিচালনা পর্ষদে নির্বাচিত হন।২০১৫ সালের মে মাসে, ইফতেখারুজ্জামান বিশ্বব্যাংক কর্তৃক গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফোরাম ফর সোশ্যাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন। ২০১৯ সালে, তিনি ভিআইপিদের দ্বারা ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে নীতি সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছিলেন। কালো টাকা (করবিহীন) বৈধ করার বিধানের কট্টর সমালোচক ড. ইফতেখারুজ্জামান। দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ড. ইফতেখারুজ্জামান
আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী:
আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী বাংলাদেশি অবসরপ্রাপ্ত একজন সরকারি কর্মকর্তা যিনি ২০০১ সালে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার সাবেক প্রধান উপদেষ্টা লতিফুর রহমান নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
১৯৯৪ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করে অবসর গ্রহণ করেন। ৩৩ বছরের কর্মজীবনে তিনি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগসহ বিভিন্ন বিভাগ ও দপ্তরের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০০ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা ছিলেন। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী।
ড: শাহদীন মালিক:
ড. শাহদীন মালিক,আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ল’র পরিচালক। তিনি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বোর্ড অব ট্রাস্টি। তিনি ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী ছিলেন।
আইনের ছাত্র শাহদীন মালিক ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন। ২০০৩ সাল থেকে উচ্চ আদালতে আইনজীবী হিসাবে কাজ করছেন তিনি। তিনি বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টেও কাজ করেন। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে ড: শাহদীন মালিক দায়িত্ব পালন করবেন।