বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ সময় টিভির পাঁচ সাংবাদিককে বরখাস্তের ঘটনায় আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এএফপির প্রকাশিত প্রতিবেদনের কোনো সত্যতা নেই। আজ বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ইংরেজিতে এ-সংক্রান্ত একটি পোস্ট দেন তিনি।
পোস্টে হাসনাত আব্দুল্লাহ লেখেন, মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর) বার্তা সংস্থা এএফপি সময় টিভিতে বেশ কিছু সাংবাদিককে বরখাস্তের কথা জানিয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত, এটিকে এমনভাবে চিত্রিত করেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন টিভি স্টেশনের মালিক সিটি গ্রুপকে সাংবাদিকদের বরখাস্ত করতে বাধ্য করেছে। তবে বাস্তবতা হলো- এতে ঘটনার কোনো সত্যতা নেই।
তিনি আরও লেখেন, জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে সময় টিভির সাংবাদিকতার বিষয়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অংশ হিসেবে আমরা সম্প্রতি সিটি গ্রুপের অফিসে গিয়েছিলাম। এ সময়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে শত শত শিক্ষার্থীসহ প্রায় ২ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন।
তিনি আরও লেখেন, আমাদের শান্তিপূর্ণ এ বিক্ষোভে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ সময়ে অনেক টিভি , সংবাদপত্র, ওয়েবসাইট সাংবাদিকতায় ন্যুনতম নৈতিকতা প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা ছাত্র এবং আন্দোলনকারীদের সন্ত্রাসী এবং দুষ্কৃতিকারী ও ইসলামি চরমপন্থি হিসেবে উল্লেখ করেছে। এভাবে করে তারা শেখ হাসিনার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ব্যাপক সমর্থন ও বৈধতা দিয়েছে।
হাসনাত আরও লেখেন, সময় টিভি এই প্রচেষ্টায় প্রধান ভূমিকা নিয়েছে। এমনটি গত ১৬ বছরে শেখ হাসিনার মানবতার বিরুদ্ধে প্রতিটি অপরাধকে সমর্থন ও বৈধতা দিয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম হলো বিচারবহিভূত হত্যা, জোরপূর্বক গুম এবং বিরোধী দলের বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্র্যাকডাউন। এছাড়া সময় টিভি শীর্ষ ভিন্নমত পোষণকারীদের বিরুদ্ধে নীরবে মিডিয়া প্রচার চালিয়েছে, যার মধ্যে ছিলেন শহিদুল আলম, ডেভিড বার্গম্যান, লিসা গাজী এবং এএফপির ফ্যাক্ট চেক সম্পাদক কদর উদ্দিন শিশির।
তিনি আরও লেখেন, এএফপি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে আমরা আমরা সিটি গ্রুপে প্রবেশ করেছি। তবে এখানে প্রতিবাদের অংশ হিসেবে প্রবেশের কথা তারা উল্লেখ করেনি। এমনকি গত ১৬ বছরে বিক্ষোভকারীদের অমানবিকতা এবং শেখ হাসিনার মানবতাবিরোধী অপরাধের বৈধতা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিতর্কিত ভূমিকা পালনের বিষয়টি উল্লেখ করেনি। এএফপি হিটলার শাসিত জার্মানিতে নাৎসি আচরণের পরিবর্তে সময় টিভির সাংবাদিকদের ভিকটিম হিসেবে উল্লেখ করার চেষ্টা করেছে।
তিনি আরও লেখেন, আমরা পুনরায় বলতে চাই যে, আমরা সময় টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে জুলাইয়ে সময় টিভির জনবিরোধী ভূমিকা নিয়ে কথা বলেছি। বরখাস্তের জন্য আমরা মালিকদের কাছে সাংবাদিকদের কোনো তালিকা দেয়নি। আমরা টিভির শেয়ারও দাবি করিনি। আমাদের মাঝে তেমন কোন আলোচনা হয়নি।
তিনি আরও লেখেন, আমার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এসব অভিযোগ করা হয়েছে। টিভি স্টেশনের মালিক বা সিটি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কোন বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে এসব অভিযোগ আসেনি। আমরা বার বার বলেছি আমরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী। আন্দোলনকালে শেখ হাসিনার নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত সাংবাদিক এবং যারা সত্য প্রকাশের জন্য নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন তাদের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। আমরা তাদের স্যালুট জানাই। আমরা সকল বিদেশি সংবাদমাধ্যমের বিপ্লবের সময় তাদের ভূমিকার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই।
কি বলা হয়েছিল সেই প্রতিবেদনে
বিনিয়োগ বিষয়ক ম্যাগাজিন ব্যারনস এবং এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে প্রোপাগান্ডার অভিযোগ তুলে বাংলাদেশের একটি টেলিভিশনের বিনিয়োগকারীদের চাপ দিয়ে ৫ জন সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করানো হয়েছে বলে ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ গত ১৭ ডিসেম্বর প্রায় ১৫ থেকে ২০ জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে সময় টেলিভিশনে বিনিয়োগকারী সিটি গ্রুপের অফিসে যান। হাসনাত এএফপিকে বলেন, আমার মন্তব্য নিয়ে সময় টেলিভিশন প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছিল এবং একটি পতিত রাজনৈতিক দলের মতামতকে স্থান দিচ্ছিল।
হাসনাত বলেন, আমরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কট্টর সমর্থক, কিন্তু সংবাদপত্রকে অবশ্যই নিরপেক্ষ থাকতে হবে। তিনি দাবি করার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা দেখেন না। কিন্তু সাংবাদিকদের বরখাস্ত করার জন্য তালিকা হস্তান্তরের বিষয়টি তিনি প্রত্যাখান করেন।
সময় টিভিতে বিনিয়োগকারী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
সাংবাদিক ওমর ফারুক সময় টিভির একজন সিনিয়র এডিটর ছিলেন, তিনি বলেন, পাঁচজনের মধ্যে তিনি ছিলেন। কারণ ছাড়াই বরখাস্তের চিঠি পেয়েছেন তিনি। ফারুক এএফপিকে বলেন, টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ আমাদের কয়েকজনকে স্টেশনের বৃহত্তর ভালোর জন্য পদত্যাগ করার জন্য অনুরোধ করেছিল। আমরা সিদ্ধান্তের জন্য একটি ব্যাখ্যা চেয়েছিলাম, কিন্তু কর্তৃপক্ষ কিছু দিতে অস্বীকার করে।
এদিকে সময় টিভি থেকে ছাঁটাই হওয়া আউটপুট এডিটর আরিফুল সাজ্জাত এই প্রসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লিখেন, ‘কর্তৃপক্ষ (বিনিয়োগকারী সিটি গ্রুপ) জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষস্থানীয় এক নেতা তাদের হুমকি দিয়েছে সময়ের ১০ কর্মীকে চাকরিচ্যুত করতে হবে, নাহলে তারা বাঁচতে পারবে না।’
তিনি আরও লিখেন, ‘এনিয়ে আমরা CA Press Wing সহ (অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং) সবার সাথে কথা বলি। তারা আশ্বস্ত করে কোন বিবেচনাতেই এ ধরনের কর্মকাণ্ড সমর্থনযোগ্য নয়। আমরা বিনিয়োগকারীদের সেটা জানাই। তারপরও গতকাল রবিবার সিটি গ্রুপ ওই তালিকা থেকে পাঁচ কর্মীকে কোন কারণ দর্শানো ছাড়াই চাকরিচ্যুত করার সিদ্ধান্ত জানায়।’
আরিফুল সাজ্জাত লিখেন, ‘আমরা অনেকেই অভ্যুত্থানের সময়ও পতিত সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ছাত্র জনতার আন্দোলনের খবর প্রচার করেছি। (আমি তখন নিউজ ২৪ এ কর্মরত ছিলাম।) ওই সময়ের নির্বাহীরা পুরো বস্তুনিষ্ঠ খবর প্রচার করতে দেয়নি। সেটা সবাই জানে। সময়ের ভূমিকা নিয়েও নতুন করে বলার কিছু নাই। তবে গণমাধ্যমটি ৫ আগস্টের পর তাবেদারির নীতি বাদ দিয়ে বস্তুনিষ্ঠ খবর প্রচার করতে থাকে। ফলে দর্শকপ্রিয়তায় পেছনে চলে যাওয়া চ্যানেলটি শিগগিরই আবার শীর্ষস্থানে আসে।’
তিনি বলেন, ‘যেভাবে পেশাদার সংবাদকর্মীদের বাদ দেয়া হলো, সেটা কোনভাবেই কাম্য নয়। এর নিন্দা আর প্রতিবাদের ভাষাও জানা নেই। এই সময়েও স্বাধীন গণমাধ্যম যে শুধু কথার কথা, সেটাই আমরা দেখছি। আর বিষয়টি জানার পরও দায়িত্বশীলদের শুধু “উঁহু আহা” প্রতিক্রিয়া, আমাদেরকে স্বৈরাচারি শেখ হাসিনার শাসনামলকেই মনে করিয়ে দেয়।’”
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস বারবার জোর দিয়ে বলেছেন, তিনি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা চান। ইউনূসের প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম বলেছেন, যদি কেউ “কোন পদক্ষেপ নেয়, দায় তাদের উপর বর্তায়।
প্রেস ওয়াচডগরা বলেছেন যে, অনেক সাংবাদিক-সমালোচকেরা হাসিনাকে ক্ষমতায় থাকাকালীন সমর্থন করেছিলেন বলে দেখেছেন। তাদের অতীত কাজের জন্য আপাত প্রতিশোধের জন্য পুলিশের তদন্তের মুখোমুখি হয়েছেন। অন্তত চারজন সাংবাদিককে কারারুদ্ধ করা হয়েছে এবং সারা দেশে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা চলছে।
হাসিনা এবং তার সরকারের বিরুদ্ধে সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেল বন্ধ করা এবং সাংবাদিকদের কারারুদ্ধ করাসহ মুষ্টিমেয় স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর অযৌক্তিক চাপ প্রয়োগের অভিযোগ আনা হয়েছে। হাসিনার সরকারের পতনের পর সময় টিভিসহ বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেল আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্যের অভিযোগে আক্রমণের মুখে পড়ে।
নভেম্বরে, বিক্ষোভকারীরা প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের অফিস ঘেরাও করে এবং বন্ধ করার হুমকি দেয়।
বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দীর্ঘদিন ধরে হুমকির মুখে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস অনুসারে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৫তম।