দীর্ঘ আলোচনা, রাজনৈতিক চাপানউতোর ও প্রত্যাশার আবহে অবশেষে প্রকাশিত হলো ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ (July National Charter 2025)। সোমবার (২৮ জুলাই) এই খসড়া সনদটি দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন (National Consensus Commission)।
এই ঐতিহাসিক সনদের ভিত্তি ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত সেই অভূতপূর্ব ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান, যা দেশের রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রিক বাস্তবতা পাল্টে দেওয়ার প্রথম সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ হিসেবে ধরা হচ্ছে।
একটি রক্তাক্ত পটভূমিতে নতুন রাষ্ট্র ভাবনার উন্মেষ
সনদের সূচনায় তুলে ধরা হয়েছে দেশের ইতিহাস ও গণতান্ত্রিক ব্যর্থতার দীর্ঘ বর্ণনা। বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে সাম্য, মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের জন্য যে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, তার আকাঙ্ক্ষিত রূপ আজও বাস্তবায়িত হয়নি। স্বাধীনতার পর বিগত ৫৩ বছরে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে একচ্ছত্র ক্ষমতার অপব্যবহার, দলীয়করণ ও বিচারহীনতার কারণে। বিশেষ করে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে অগণতান্ত্রিক শাসন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম-খুন-নিপীড়নের মাধ্যমে এক বিভীষিকাময় শাসন কায়েমের।
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান সেই দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ছিল এক ঐতিহাসিক প্রতিবাদ। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নারী, পুরুষ, শিশু, তরুণসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ জড়িত হন। আন্দোলনে প্রাণ হারান ১,৪০০-এর বেশি মানুষ, আহত হন ২০,০০০-এর অধিক। এই আত্মত্যাগের ভিত্তিতেই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় এবং শুরু হয় রাষ্ট্র সংস্কারের প্রক্রিয়া।
ছয়টি সংস্কার কমিশনের কাজ ও ঐকমত্য গঠনের উদ্যোগ
২০২৪ সালের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে ড. মুহাম্মদ ইউনূস (Muhammad Yunus) প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর সরকার ছয়টি পৃথক সংস্কার কমিশন গঠন করে—সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে। কমিশনগুলো ২০২৫ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিল করে।
এর ধারাবাহিকতায় গঠিত হয় ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’, যার মূল দায়িত্ব ছিল সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ পর্যালোচনা করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ও একটি অভিন্ন সনদ প্রণয়ন।
কমিশন ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ৪৪টি বৈঠক করে, এবং দ্বিতীয় দফায় ২০টি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়ে আরও আলোচনা হয়। এর ভিত্তিতেই ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ প্রণীত হয়েছে।
সনদের প্রধান ঘোষণা ও অঙ্গীকার
সনদটিকে একটি সম্মিলিত রাজনৈতিক দলিল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, যা ভবিষ্যতের সরকার পরিচালনার রূপরেখা হিসেবে কাজ করবে। এতে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো শাসন ব্যবস্থার কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে ঐকমত্যে পৌঁছেছে।
মূলত এই সনদের মাধ্যমে সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন পদ্ধতি, জনপ্রশাসন, পুলিশি কাঠামো এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে এক যৌথ প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করা হয়েছে।
প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে রয়েছে—
১) নির্বাচনের পর গঠিত সরকার দুই বছরের মধ্যে এই সনদের সকল সুপারিশ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার পালন করবে;
২) এই বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংশোধন, আইনি সংস্কার ও নতুন আইন প্রণয়ন সম্পন্ন করা হবে;
৩) প্রতিটি ধাপে সনদের আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে;
৪) ২০২৪ সালের গণআন্দোলনের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সংবিধানে স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
একটি প্রতীকী ঘোষণার গভীর রাজনৈতিক তাৎপর্য
‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর মাধ্যমে একদিকে যেমন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার প্রচেষ্টা কাঠামোগত ভিত্তি পেল, অন্যদিকে তা ভবিষ্যৎ সরকারের জন্য একটি দায়বদ্ধতার চুক্তি হিসেবেও কাজ করবে।
সনদটি শুধু একটি রাজনৈতিক দলিল নয়; এটি এক রক্তাক্ত ইতিহাস, আত্মত্যাগ আর গণআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। এটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সূচিত হবে—সেখানে থাকবে জবাবদিহি, নাগরিক অধিকার, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা ও সুশাসনের নিশ্চয়তা।