জুলাই সনদকে সামনে রেখে একাধিক রাজনৈতিক দলের মধ্যে নতুন করে জোট গঠনের আলোচনা চলছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (National Citizen Party – NCP) সহ নয়টি দল একত্রিত হয়ে নতুন একটি বলয় তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। বিএনপি ও জামায়াতের মতোই এদের লক্ষ্যও আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে। শুধু জোট নয়, কয়েকটি দলের মধ্যে একীভূত হওয়ার আলোচনাও এগোচ্ছে। তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এখন—এই নতুন জোট শেষ পর্যন্ত বিএনপি না জামায়াত, কোন বলয়ে যাবে?
এই নয় দলীয় উদ্যোগে আছেন এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টি এবং গণতন্ত্র মঞ্চের ছয় শরিক—জেএসডি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, নাগরিক ঐক্য, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন ও ভাসানী জনশক্তি পার্টি। বিএনপি আগেই গণতন্ত্র মঞ্চকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচন ও সরকার গঠনের ঘোষণা দিয়েছিল। তবে জুলাই সনদ নিয়ে তাদের অবস্থান এক নয়। গণতন্ত্র মঞ্চ চাইছে পিআর পদ্ধতির উচ্চকক্ষ, আইনি ভিত্তিতে সনদ এবং সাংবিধানিক সংস্কার সভা, অন্যদিকে বিএনপি এসব সংস্কারকে পরবর্তী সংসদে বাস্তবায়নের পক্ষপাতী। জামায়াতসহ সাত দল আবার নির্বাচনের আগেই গণভোট ও সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে পরিবর্তন চায়।
সংবিধান আদেশ জারির ক্ষমতা অন্তর্বর্তী সরকারের রয়েছে কিনা তা জানতে সুপ্রিম কোর্টের মতামত চেয়েছে বিএনপি। তবে ৯ দল আদালতে বিষয়টি নিতে রাজি নয়। এক শীর্ষ নেতা খোলাখুলিভাবেই বলেছেন, আসন ভাগাভাগির অনিশ্চয়তাই তাদের কাছাকাছি টেনে এনেছে। আলাদা থাকলে বিএনপি বা জামায়াতের সঙ্গে দরকষাকষিতে সুবিধা পাওয়া যাবে না, তাই ঐক্যবদ্ধ থাকা জরুরি। যদিও বামপন্থি কয়েকটি দল জামায়াতের সঙ্গে আপসে একেবারেই রাজি নয়।
অন্যদিকে, এনসিপি ও গণঅধিকার পরিষদের একীভূত হওয়ার আলোচনাও এগোচ্ছে। তবে প্রধান অন্তরায় নেতৃত্ব কাঠামো। গণঅধিকার চাইছে নুরুল হক নুর শুরুতে একীভূত দলের প্রধান হোন, পরে সভাপতি হোক নাহিদ ইসলাম। এনসিপি এর বিপক্ষে; তারা চায় নুর তৃতীয় অবস্থানে থাকুক। যদিও রাশেদ খানসহ গণঅধিকারের শীর্ষ নেতাদের “শীর্ষ দশে” রাখার কথা ভাবা হচ্ছে। এনসিপির আরিফুল ইসলাম আদীব জানিয়েছেন, নুরুল হকের চিকিৎসা শেষে আলোচনায় গতি আসতে পারে।
এছাড়া শুধু এই দুই দল নয়, আলোচনায় যোগ দিতে পারে আপ বাংলাদেশও। সূত্র মতে, এনসিপি, গণঅধিকার এবং অন্যান্য তরুণ নেতৃত্বের সংগঠনগুলো একীভূত হলে তা নতুন শক্তি গড়ে তুলতে পারে। যদিও এই আলোচনা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে।
বিএনপির সঙ্গে একাধিক দল ইতিমধ্যেই সমঝোতায় এগিয়েছে। ১২ দলীয় জোট, ১১ দলীয় জোট, এলডিপি, এনডিএম, বিজেপি ও লেবার পার্টি বিএনপির সঙ্গেই রয়েছে। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম পার্টি ও ইসলামী ঐক্যজোটের অংশও বিএনপির বলয়ে আসতে চাইছে। বিভিন্ন নেতাকে নির্বাচনী এলাকায় সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও রেখেছে বিএনপি। তবে গণঅধিকার পরিষদ সাম্প্রতিক সময়ে তাদের আসন ছাড়ের তালিকা থেকে বাদ পড়েছে, যদিও দলটির একাংশ এখনো বিএনপির কাছাকাছি যেতে আগ্রহী।
আলোচনা সূত্র জানায়, জুলাই সনদ ঘিরে বিএনপি ও জামায়াতের অবস্থানের পার্থক্য সমঝোতার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে জামায়াতের ঐতিহাসিক বিতর্ক, অন্যদিকে বিএনপির প্রতি গত এক বছরে তৈরি হওয়া ক্ষোভ—দুটি দলের সঙ্গেই সরলভাবে আপসে যাওয়া কঠিন। তবুও ৯ দল নিজেদের বিকল্প শক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। এনসিপির আরিফুল ইসলাম আদীব বলছেন, তারা কেবল বিএনপি বা জামায়াতের ছায়ায় থাকতে চান না, বরং আলাদা বলয় হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করতে চান। রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের দিদারুল ভূঁইয়া মনে করেন, “ফ্যাসিবাদের পতনে গণতন্ত্র মঞ্চ একসময় বিএনপির সঙ্গে ছিল, কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টেছে। সমঝোতা এখন আর সহজ বিষয় নয়।”