জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একসাথে হলে তা ‘নির্বাচনের জেনোসাইড’ ডেকে আনতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ডা. শফিকুর রহমান (Dr. Shafiqur Rahman), জামায়াতে ইসলামীর (Jamaat-e-Islami) আমির। তবে তিনি স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, তাদের পক্ষ থেকে কোনো সংকট সৃষ্টি করা হবে না।
শনিবার (২২ নভেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম সফরে এসে নগরীর প্যারেড ময়দানে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি এসব মন্তব্য করেন।
নির্বাচনের দিন গণভোট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “এটা আমরা ভালোভাবে দেখছি না। আমরা আগেই বলেছি, নির্বাচনের দিন গণভোট হলে নির্বাচনের জেনোসাইড হওয়ার আশঙ্কা আছে।”
বিএনপির দাবি অনুযায়ী, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের বিষয়ে জামায়াতের অবস্থান নরম হয়েছে কি না—এমন প্রশ্নে ডা. শফিক বলেন, “দেখেন, আমাদের এত পজেটিভ চিন্তা, আমরা জাতির জন্য কী করব, সেগুলো বলতে বলতেই আমাদের সময় চলে যায়। কাউকে খোঁচা দেওয়া বা কারও খোঁচার জবাব দেওয়ার সময় আমাদের নেই। আমাদের অবস্থান পরিষ্কার। আমাদের দাবি অব্যাহত আছে। এবং সেই দাবি বাস্তবায়ন হবে জনগণের স্বার্থে। আমরা কথা দিচ্ছি, ইনশাআল্লাহ আমরা ক্ষমতায় গেলে সেই পিআর (সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা) বাস্তবায়ন করব।”
তিনি স্বীকার করেন, “লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই।” তবে বলেন, “এটা আমাদেরই তৈরি করতে হবে। আমাদের মানে সবাইকে নিয়ে। সবাই তৈরি থাকুন, এ নির্বাচন হতে হবে। এ নির্বাচন না হলে দেশে সংকট দেখা দেবে। আমরা কোনো সংকট তৈরি হতে দেব না, ইনশাআল্লাহ।”
স্থানীয় নির্বাচনকে ঘিরে জামায়াতের কোনো আলাদা দাবি নেই বলেও জানান দলটির আমির। বলেন, “আমরা এখন স্থানীয় নির্বাচনের কথা বলছি না, কারণ এটা সম্ভব নয়। আমরা অবাস্তব কোনো দাবি কখনো পেশ করিনি, করবও না।”
জোট নিয়ে স্পষ্ট অবস্থান তুলে ধরে ডা. শফিক বলেন, “আমরা এটা ক্লিয়ার করেছি যে, আমরা কনভেনশনাল কোনো জোট করব না। কিন্তু অনেকগুলো দল এবং শক্তির সঙ্গে আমাদের নির্বাচনি সমঝোতা হবে ইনশাআল্লাহ।”
চট্টগ্রামে জামায়াত প্রার্থীদের জয়ের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমি চট্টগ্রামের সকল আসনে জামায়াতের প্রার্থী জয়ের কোনো বার্তা দেব না, আমি জনগণের বিজয়ের বার্তা দেব। আমি জামায়াতের বিজয় চাচ্ছি না, আমি জনগণের বিজয় চাচ্ছি।”
সফরের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি জানান, বিকেল পৌনে ৪টার দিকে হেলিকপ্টারে করে তিনি চট্টগ্রাম নগরীর প্যারেড ময়দানে অবতরণ করেন। সেখানে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
এক মাদরাসার বার্ষিক মাহফিলে অংশ নিতে চট্টগ্রামে এসেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি একটা মাদরাসার বার্ষিক মাহফিলে দাওয়াত পেয়েছি, সেখানে উনাদের সম্মানিত করতে এসেছি। এর আগে দক্ষিণবঙ্গের নেছারাবাদ মাদরাসার বার্ষিক মাহফিলে দাওয়াত পেয়ে সেখানে গিয়েছিলাম, সেখান থেকে এখানে এসেছি। বাংলাদেশে এই একটা জেলার নামের আগে বীর শব্দ ব্যবহার হয়, এটার নাম চট্টগ্রাম, অবশ্য বীর চট্টগ্রাম বলা হয় না, বলা হয় বীর চট্টলা। আসলে ইতিহাসটা বীরত্বের ইতিহাস।”
বাংলাদেশ এখন ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমরা সাতচল্লিশ পার হয়ে এসেছি, বায়ান্ন পার হয়ে এসেছি, একাত্তর পার হয়ে এসেছি, এখন আমরা দাঁড়িয়েছি চব্বিশের কোলে। বারবার এ জাতির সামনে সুযোগ এসেছে। কিন্তু সুযোগের উত্তম ব্যবহার যাদের করার কথা ছিল, তারা সেটা না করে সুযোগের অপব্যবহার করেছে। যার কারণে এ অঞ্চল দুই-দুইবার স্বাধীনতার আলো দেখার পরও সেই আলো অনেকটা নিভু নিভু হয়ে গেল।”
তিনি বলেন, “দ্বিতীয় স্বাধীনতার আজ ৫৪ বছর। এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় একটা জাতির বহুদূর এগিয়ে যাবার কথা ছিল। সম্পদের লীলাভূমি এই চট্টগ্রাম, বিশেষ করে বাংলাদেশ। কিন্তু আমরা সেই সম্পদের উপকারভোগী হতে পারলাম না কেন? কিছু লোক জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করে তাদের পকেট ভারী করেছে। কিন্তু কার্যত জনগণ সেই উন্নয়নের মুখ দেখেনি।”
শিক্ষা, শিল্প ও উৎপাদনের দিক থেকে দেশের পিছিয়ে পড়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছে। নতুনভাবে শিল্পকারখানা হচ্ছে না। আমাদের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ ব্যাপক থাকা সত্ত্বেও চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম। সবকিছু একটাই কারণ—বিচক্ষণ, আন্তরিক, দেশপ্রেমিক ও সৎ নেতৃত্বের অভাব। এই চারটি উপাদান না থাকায় দেশ বারবার মুখ থুবড়ে পড়ছে। সুযোগ এসেছে, হারিয়ে গেছে। আমরা ২০২৪-এর এই সুযোগ আর হারাতে চাই না। এই সুযোগের ষোল আনা সদ্ব্যবহার আমরা করতে চাই।”
জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জন্য রাজনীতির প্রত্যয় ব্যক্ত করে জামায়াত আমির বলেন, “কোনো দল নয়, গোটা জাতি, আপামর জনগণ এই দেশের মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সকলের জন্য। আরও যারা জাতি-উপজাতি সকলের জন্য, এই বাংলাদেশের সীমানায় যারা বসবাস করে সবার জন্য। আমরা সবার কণ্ঠ হতে চাই। এজন্য আমরা আল্লাহর নামে ঘোষণা করেছি, আমাদের যুদ্ধ হবে এ দেশকে সত্যিকারের মুক্তির স্বাদ এনে দেওয়ার জন্য। যুদ্ধ হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে। এ যুদ্ধ হবে আপসহীন। এ যুদ্ধে ইনশাআল্লাহ আমরা কারও কাছে মাথানত করবো না। গন্তব্যে না পৌঁছা পর্যন্ত কেউ আমাদের থামাতে পারবে না, আমরা ইনশাআল্লাহ থামবো না।”
নিজস্ব রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষা ও জনগণের অধিকারে অটল থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করে তিনি বলেন, “কারও কাছে আমরা আমাদের রাজনীতি ইজারা দিতে চাই না। কোনো দল নয়, কোনো পরিবার নয়। এদেশের মালিক এদেশের জনগণ। আমরা জনগণের হাতে জনগণের অধিকার তুলে দিতে চাই। দুর্নীতির জট যদি খুলে ফেলা যায়, তাহলে সমাজের উন্নয়নের অন্যান্য জটগুলোও খুলে ফেলা যাবে, ইনশাআল্লাহ। আবারও ঘোষণা করছি, আমরা কোনো অপশক্তির কাছে মাথানত করবো না। এই মাথা নত হবে শুধুমাত্র রাব্বুল আলামীনের সামনে।”
এই সফরে জামায়াতে ইসলামীর চট্টগ্রাম মহানগর, দক্ষিণ ও উত্তর জেলার নেতারা আমিরের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন।


