বিএনপির প্রার্থী তালিকা ঘিরে এখনো চলছে বিক্ষোভ, মানববন্ধন- চলছে সমঝোতার চেষ্টা

আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি (BNP) ঘোষিত প্রার্থী তালিকাকে ঘিরে সারা দেশে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। প্রার্থী পুনর্বিবেচনার দাবিতে অন্তত আটটি আসনে শনিবার (গতকাল) মানববন্ধন, বিক্ষোভ, মশাল মিছিল ও সড়ক অবরোধ হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি আসনে বিএনপির ঘোষিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে এবং একটি আসনে এখনো প্রার্থী ঘোষণা না করায় বিক্ষোভ হয়।

গত ৩ নভেম্বর বিএনপি ২৩৭টি আসনে প্রাথমিক প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ করে। এরপর থেকেই বিভিন্ন জেলায় মনোনয়ন বঞ্চিত নেতাদের কর্মী-সমর্থকরা বিক্ষোভে নামেন। দলীয় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এতটাই বেড়েছে যে একাধিক জায়গায় সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে।

চট্টগ্রামে ৪০ কিলোমিটারজুড়ে মানববন্ধন

চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড ও নগরের একাংশ) আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে বড় দারোগারহাট থেকে অলংকার মোড় পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটারজুড়ে মানববন্ধন হয়। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আসলাম চৌধুরীর অনুসারীরা এ কর্মসূচির আয়োজক ছিলেন। বেলা ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত চলে মানববন্ধন, যেখানে নারীরাও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।

সীতাকুণ্ড পৌর বিএনপির সদস্যসচিব সালেহ আহম্মদ বলেন, “আমরা চাই আসলাম চৌধুরীকে মনোনয়ন দেওয়া হোক। এই দীর্ঘ মানববন্ধনের মাধ্যমে আমরা কেন্দ্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।”

ঢাকা-১৪: মশাল মিছিল ও প্রতিবাদ

ঢাকা-১৪ আসনে সানজিদা ইসলাম (তুলি)-এর পরিবর্তে এস এ সিদ্দিক সাজুকে মনোনয়নের দাবিতে মশাল মিছিল হয়। শাহ আলী মাজার থেকে সনি সিনেমা হল পর্যন্ত এই মিছিলের মধ্য দিয়ে সানজিদার ধর্ম নিয়ে মন্তব্যেরও প্রতিবাদ করা হয়। মিছিলকারীদের দাবি, তিনি ইসলাম ধর্মের বিধান নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন। উল্লেখ্য, এস এ সিদ্দিক দারুস-সালাম থানা বিএনপির আহ্বায়ক এবং সানজিদা ‘মায়ের ডাক’ নামের সংগঠনের সমন্বয়ক।

মুন্সিগঞ্জ-১: এক্সপ্রেসওয়ে অবরোধ

সিরাজদিখান-শ্রীনগর নিয়ে গঠিত মুন্সিগঞ্জ-১ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন শেখ মো. আবদুল্লাহ। কিন্তু দলের আরও তিন প্রভাবশালী নেতার অনুসারীরা এ প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে একাধিক কর্মসূচি পালন করেন। শ্রীনগর স্টেডিয়ামে সমাবেশ ও এক্সপ্রেসওয়েতে অবরোধ হয়। কিছু সময়ের জন্য যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। পরে মীর সরাফত আলীর হস্তক্ষেপে সড়ক অবরোধ তুলে নেওয়া হয়।

রাজশাহীতে সড়কে শুয়ে প্রতিবাদ

রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনে স্থানীয় প্রার্থী না পেয়ে প্রতিবাদস্বরূপ মহাসড়কে শুয়ে বিক্ষোভ করেন নেতাকর্মীরা। বর্তমান প্রার্থী শফিকুল হক রাজশাহী-২-এর ভোটার—এই যুক্তিতে তাকে প্রত্যাখ্যান করেন বিক্ষোভকারীরা। বক্তৃতায় রাজশাহী জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি রায়হানুল আলমকে প্রার্থী করার দাবি ওঠে।

গাইবান্ধা-১: চিকিৎসক প্রার্থী প্রত্যাখ্যান

গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনে প্রার্থী খন্দকার জিয়াউল ইসলামের পরিবর্তে স্থানীয় ব্যবসায়ী আরেফিন আজিজ সরদারকে প্রার্থী করার দাবি জানিয়ে বিক্ষোভ করেন নেতাকর্মীরা। তাদের অভিযোগ, জিয়াউল ইসলাম পেশাগত কারণে ঢাকায় থাকেন, তাই এলাকার সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা কম।

মেহেরপুর-২: টানা মানববন্ধন

গাংনীতে আমজাদ হোসেনের মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। মানববন্ধনের আয়োজকরা জেলা বিএনপির সভাপতি জাভেদ মাসুদকে প্রার্থী করার আহ্বান জানান।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ ও কিশোরগঞ্জ-৫: একই দাবিতে প্রতিবাদ

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা-আখাউড়া) আসনে মুশফিকুর রহমানের মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন হয়। মনোনয়নপ্রত্যাশী কবির আহমেদ ভূঁইয়ার পক্ষে আন্দোলনে নেমেছেন তাঁর অনুসারীরা।

অন্যদিকে, কিশোরগঞ্জ-৫ (বাজিতপুর-নিকলী) আসনে এখনো প্রার্থী ঘোষণা না করায় দলের কর্মীরা বিক্ষুব্ধ। শেখ মুজিবুর রহমান ইকবালকে প্রার্থী করার দাবিতে বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন হয়।

দলীয় কোন্দলে অস্থিরতা বাড়ছে

বিএনপির প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর অন্তত ২০টি জেলায় মনোনয়নবঞ্চিত নেতাদের তৎপরতা স্পষ্ট। দলীয় কোন্দল নিরসনে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান (Tarique Rahman) একটি কমিটি গঠন করেছেন, যারা প্রার্থী ও মনোনয়ন বঞ্চিতদের সঙ্গে আলোচনা করছেন।

তবুও অনেক নেতাই প্রকাশ্যে আসছেন না, বহিষ্কারের ভয়ে নেপথ্যে থাকছেন। তাদের সমর্থকরা বিক্ষোভ, মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন চালিয়ে যাচ্ছেন। নেতারা অভিযোগ করছেন, যারা এলাকার সঙ্গে সংযুক্ত নন, তাদের প্রার্থী করায় নির্বাচনে প্রভাব পড়বে।

আরও আসনে আন্দোলন

চাঁদপুর-২, ময়মনসিংহ-৩, মাদারীপুর-১, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪, কুষ্টিয়া-৪, মাগুরা-২, টাঙ্গাইল-৩, চট্টগ্রাম-১২, গাইবান্ধা-৪, নরসিংদী-৪–সহ আরও অনেক আসনে চলছে আন্দোলন। এর মধ্যে কোথাও কোথাও সংঘর্ষও ঘটছে। যেমন গৌরীপুরে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে একজন ছাত্রদল নেতা নিহত হন।

দলীয় সূত্র বলছে, বেশ কয়েকটি আসনে প্রার্থিতা স্থগিতের চিন্তাভাবনা চলছে। গোপালগঞ্জ-২, সিরাজগঞ্জ-৩ ও নরসিংদী-৪ আসনেও দলীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে মাঠে প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।

তবে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা আশাবাদী, চূড়ান্ত মনোনয়ন ঘোষণার পর এই সংকট কেটে যাবে। সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী (Ruhul Kabir Rizvi) বলেন, “বড় দলে অনেক যোগ্য প্রার্থী থাকে। প্রাথমিক ঘোষণার পর কিছু অসন্তোষ থাকতেই পারে। কিন্তু চূড়ান্ত তালিকা ঘোষণার পর সবাই একত্রিত হয়, তখন দল সবচেয়ে বড় হয়ে ওঠে।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *