বৈষম্যের শিকার ‘ওয়াসিমদের রক্ত’ কম লাল ছিল না

মনে পড়ে জিসানকে? রূপগঞ্জের তুলতা ইউনিয়নের ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদকের সেই অগ্নিকণ্ঠ, যে পুলিশের কাছেও মাথা নত করেনি, শিকলবন্দি হয়েও গর্জে উঠেছিল স্বাধীনতার স্লোগানে। ২০২৪-এর ডামি নির্বাচনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আগুনে জিসান ছিল এক সাহসী প্রদীপ। তাঁর সেই অগ্নিময় কণ্ঠস্বর যেন স্বৈরাচারী শক্তির বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার অবিনশ্বর প্রতীক। কিন্তু সেই সাহস, সেই প্রতিরোধকে থামাতে এক নৃশংস রাতে ছাত্রলীগের হাতে অকালে ঝরে যায় জিসানের প্রাণ। জুলাই ম্যাসাকারের সেই নিষ্ঠুর অধ্যায় কেবল জিসানকে ছিনিয়ে নেয়নি, ছিনিয়ে নিয়েছিল আমাদের গণতন্ত্রের আরেকটি দীপ্ত প্রদীপ। তবু জিসান আজও জীবিত, আমাদের প্রতিবাদে, আমাদের স্বপ্নে, আমাদের অঙ্গীকারে।

কিছুদিন আগেই ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে নিহত, মাগুরা জেলা ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শহীদ মেহেদী হাসান রাব্বি কন্যা সন্তানের পিতা হয়েছেন। মনে পড়েছে তাঁর কথা, স্মরণ করেছেন? কান্নায় ভেঙে পড়েছেন? আবেগে আপ্লুত হয়েছেন?
মনে পড়ে নুরুজ্জামান জনির কথা? খিলগাঁও থানা ছাত্রদলের সেই অমিত তেজের প্রতীক, যে স্বপ্ন দেখত এক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার। কিন্তু সেই স্বপ্নের মশাল যেন নিভিয়ে দিতে চেয়েছিল স্বৈরাচারের অন্ধ প্রতিহিংসা। কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে জনির শরীরে পনেরোটি গুলি ঝাঁঝরা করে দেয় তার জীবন্ত স্বপ্নকে। একজন মানুষকে হত্যা করতে এত গুলি লাগে? না, এটি ছিল শুধু একটি জীবন নয়, একটি আদর্শকে ধ্বংস করার নৃশংস প্রচেষ্টা। জনির রক্তে লাল হয়ে আছে আমাদের পতাকার মাটি, তার ত্যাগ আমাদের অঙ্গীকার করিয়ে দেয়—এই নিপীড়ন, এই অন্যায়ের শেষ আমরা করবোই। জনি নেই, কিন্তু তার লড়াই আজও আমাদের পথ দেখায়।


ওয়াসিম আকরাম, চট্টগ্রামের প্রথম শহীদ। ২০২৪-এর অভ্যুত্থানে তার রক্তে ভেজা বীর চট্টলার মাটি আজও গর্জে ওঠে, তার সাহসিকতার গল্প চুপিচুপি বাতাসে ভাসে। কিন্তু কী নির্মম বাস্তবতা! এই অবদানের স্বীকৃতিতে চারদিকে নীরবতা। যারা গণতন্ত্র আর মুক্তির পতাকা হাতে জীবন দিয়েছেন, সেই তালিকা থেকে যেন খুব সচেতনভাবেই মুছে ফেলা হয়েছে ওয়াসিমের নাম। কারণ তিনি ছাত্রদলের নেতা ছিলেন। এই ছাত্র সংগঠনটি আজ অনেকের কাছে “অপরাধী”—তাদের অপরাধ, তারা স্বৈরাচারের শিকল ভাঙতে লড়াই করছে, তারা নির্বাচনের ফয়সালা জনগণের হাতে ফেরাতে চায়, আর নির্বাচন হলেই নাকি তাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে চলে আসবে। এমনকি বইয়ের পাতায় মুগ্ধ কিংবা আবু সাঈদের নাম আসলেও ওয়াসিমের নাম যেন অনুচ্চারিত। কিন্তু কেন এই বৈষম্য? ওয়াসিমের রক্ত কি কম লাল ছিল? তার জীবন কি কম মূল্যবান ছিল?


বিএনপি এবং তার অঙ্গসংগঠন ১৬ বছর ধরে এই ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে। জীবনের বিনিময়ে গণতন্ত্রের বীজ রোপণ করে গেছেন অগণিত নেতা-কর্মী। এই অভ্যুত্থান, এই গণজাগরণ কোনো একক দিনের অর্জন নয়। ওয়াসিমের লড়াই সেই দীর্ঘ আন্দোলনের এক দীপ্ত প্রতীক। অথচ আজকের অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে ছাত্র সংশ্লিষ্ট সব উদ্যোগে শুধু একদলীয় মনোভাব। কেন অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে? এই বৈষম্য কি কোনো নতুন ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত নয়? ওয়াসিমদের নাম ইতিহাসে লুকিয়ে রাখা যায় না, কারণ তাদের রক্তেই লেখা হয়েছে আমাদের প্রতিরোধের মহাকাব্য। ওয়াসিম বেঁচে থাকবেন প্রতিটি ছাত্রের শ্লোগানে, প্রতিটি বিদ্রোহী কণ্ঠে, আর প্রতিটি সত্যের দাবিতে।

অবৈধ প্রধানমন্ত্রী ফ্যাসিস্ট হাসিনার ক্ষমতার সময়কালে বিএনপির ১ হাজার ৫৫১ জন নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ৮৩৭ জন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন। ৬০০ এর অধিক নেতাকর্মী গুম হয়েছেন। গণঅভ্যুত্থানে ৪২২ জন বিএনপি সদস্য নিহত হয়েছেন, যার অর্ধশত ছিল ছাত্রদলের। সরকারি দমন-পীড়নের কারণে প্রায় ১ লক্ষ ৪৫ হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে শুধু বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে, যেখানে মোট ৬০ লক্ষ নেতাকর্মী জড়িত ছিলেন।


স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিএনপির যে আত্মত্যাগ, তা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই—আর সেই লড়াইয়ের অগ্রভাগে ছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, যারা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে, নির্যাতনের তীব্র যন্ত্রণায় জর্জরিত হয়েও গণতন্ত্রের পতাকা তুলে ধরেছে। সাংগঠনিক সম্পাদক আমান উল্লাহ আমান থেকে শুরু করে সহ সভাপতি আবু জাফরের মতো নেতারা শুধু গ্রেফতারই হননি, অকথ্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব, সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির নিজেরা আহত হয়েছেন, জীবন বাজি রেখে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কত অগণিত নেতাকর্মী এই অভ্যুত্থানে প্রাণ দিয়েছেন, অথচ তাদের ত্যাগ আজ আলোচনার বাইরে! ছাত্রদলের ত্যাগের কান্না আজ কোথায় হারিয়ে গেল? যারা রক্ত ঝরিয়েছে, যারা প্রতিরোধ গড়েছে, সেই ছাত্রদলের অবদান কি এমনই অকৃতজ্ঞতার আড়ালে ঢাকা পড়ে যাবে? গণতন্ত্রের জন্য তাদের এই অমূল্য ত্যাগের স্বীকৃতি না দেওয়া ইতিহাসের প্রতি এক চরম অন্যায়। ছাত্রদলের আত্মত্যাগ শুধু বিএনপির নয়, এটি পুরো জাতির অর্জন, যার গৌরব চিরকাল প্রজ্বলিত থাকবে।

পরিশেষে একটি কথাই বলি—শহীদ জিয়াউর রহমান যখন স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন, মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত যোদ্ধাদের একত্রিত করে বিএনপি গড়ে তুললেন, তখন তাঁর লক্ষ্য ছিল একটি স্বপ্নের বাংলাদেশ। অথচ আজ সেই ইতিহাসকে মুছে ফেলে, মুক্তিযুদ্ধের একচ্ছত্র দাবিদার হতে চেয়েছে আওয়ামী লীগ, আর শেখ হাসিনা তো তার বাবাকেই একক নায়ক বানানোর চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু ইতিহাসে কোনো একক নায়কের স্থান নেই, মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ছিল একটি জাতির, একটি জনগণের সম্মিলিত ত্যাগের ফসল।

আজকের গণঅভ্যুত্থানও তেমনই—একটি জাতির অভ্যুত্থান। এই লড়াইয়ে ছাত্রদলের অবদান যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি ওয়াসিম, জনি, বাপ্পী, জিসানরা আমাদের সাহসের প্রতীক।

ফ্যাসিস্ট শাসনের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে ছাত্রদল নিজেদের পরিচয় প্রকাশ্যে রেখেই লড়াই করেছে, রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে। আবু সাইদ, মুগ্ধরা যেমন আমাদের প্রেরণা দিয়েছে, তেমনি ওয়াসিমরা আমাদের শক্তির উৎস। এই লড়াই কোনো একক সংগঠন বা ব্যক্তির নয়, এটি পুরো জাতির বিজয়ের গল্প—এবং এই গল্পে সকল ত্যাগের স্বীকৃতিই সমান গুরুত্বপূর্ণ।

মাহবুব নাহিদ (রাজনৈতিক বিশ্লেষক)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *