ভারতের সুপ্রিম কোর্ট (Supreme Court) ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশে ছুড়ে দিয়েছে একগুচ্ছ কঠিন প্রশ্ন। আজ বুধবার (১৬ এপ্রিল) আদালতে এই বিতর্কিত আইনকে ঘিরে ৭৩টি পৃথক পিটিশনের শুনানির সময়, প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্নার নেতৃত্বে গঠিত বেঞ্চ ওয়াকফ সংক্রান্ত মূলনীতি এবং তাতে অমুসলিমদের সম্পৃক্ততা নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন তোলে।
শুনানির সময় প্রধান বিচারপতি কেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করেন, “হিন্দু দেবোত্তর বোর্ডে কি কোনো মুসলিমকে সদস্য করা হয়? যদি না করা হয়, তাহলে ওয়াকফ বোর্ডে হিন্দুকে সদস্য করা হচ্ছে কেন?” এই উক্তি আদালত কক্ষে তীব্র সাড়া তোলে। বেঞ্চে আরও ছিলেন বিচারপতি সঞ্জয় কুমার ও কেভি বিশ্বনাথন।
ভারতের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি (NDTV)-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, নরেন্দ্র মোদি সরকারের আমলে সংশোধিত ওয়াকফ আইন কার্যকর হয়। এই আইনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে একাধিক আবেদনকারী সুপ্রিম কোর্টে যান। শুনানির সময় আদালত ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ অর্থাৎ ব্যবহারভিত্তিক ওয়াকফ পদ্ধতি এবং ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্য অন্তর্ভুক্তির যৌক্তিকতা নিয়ে কেন্দ্রের ব্যাখ্যা দাবি করে।
ওয়াকফ এমন একটি প্রাচীন প্রথা, যেখানে মুসলিম সম্প্রদায়ের দ্বারা দান করা জমি বা সম্পত্তিকে ধর্মীয় বা সামাজিক কাজে ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত করা হয়। বহু ক্ষেত্রে এই সম্পত্তির কোন প্রাতিষ্ঠানিক দলিলপত্র না থাকলেও সেটিকে ‘ওয়াকফ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নতুন আইনে বলা হয়েছে, কেবলমাত্র দলিল থাকা বিরোধপূর্ণ কিংবা সরকারি জমির ক্ষেত্রেই ওয়াকফের দাবি খাটবে না।
আবেদনকারীদের পক্ষে প্রবীণ আইনজীবী কপিল সিবাল (Kapil Sibal) যুক্তি দেন, “ওয়াকফ ইসলামের অঙ্গ। কয়েক হাজার বছর ধরে এই প্রথা চলে আসছে। এখন কাগজপত্র চাওয়া মানে পুরো ব্যবস্থাকেই চ্যালেঞ্জ করা। এটি ভারতের সংবিধানের ২৬ নম্বর ধারা লঙ্ঘন করে।” তিনি আরও বলেন, ওয়াকফ বোর্ডে জেলা প্রশাসককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যিনি সরকারের অংশ। এমন ব্যক্তি যদি ওয়াকফ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেন, তবে তা সাংবিধানিক কাঠামোর বাইরে চলে যাবে।
আরেক আইনজীবী অভিষেক মনু সিংভি (Abhishek Manu Singhvi) আদালতকে জানান, ভারতে প্রায় ৮ লাখ ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে, যার অর্ধেক—প্রায় ৪ লাখ—‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ ভিত্তিক। এসব সম্পত্তির কোনো লিখিত প্রমাণপত্র নেই, কারণ তারা শতাব্দী প্রাচীন। নতুন আইনে এইসব সম্পত্তির ক্ষেত্রে দলিল দেখাতে হবে, নইলে সেই সম্পত্তি রাষ্ট্রের মালিকানায় চলে যাবে।
প্রধান বিচারপতি নিজেও বিষয়টির ঐতিহাসিকতা ও বাস্তবতা তুলে ধরে বলেন, “দিল্লি হাইকোর্ট নিজেও ওয়াকফ সম্পত্তির ওপর গঠিত বলে আমরা শুনেছি। এই জমির কোনো দলিল নেই, অথচ আদালতই সেটি ব্যবহার করছে। তাহলে কি এই ব্যবহারও অবৈধ?” তিনি আরও বলেন, অধিকাংশ মসজিদ গঠিত হয়েছে ১৪শ বা ১৫শ শতকে। সেসব সম্পত্তির দলিল থাকা প্রায় অসম্ভব।
যদিও সুপ্রিম কোর্ট ওয়াকফ সংশোধনী আইনের ওপর কোনো অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ দেয়নি, তবে আগামী বৃহস্পতিবার পুনরায় শুনানির দিন ধার্য করেছে। এই মামলার ফলাফল কেবল ওয়াকফ ব্যবস্থার জন্য নয়, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রের ভূমিকার প্রশ্নেও একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।