আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশেই ছিলো গোগন কারাগার

একটি দরজা, ইট দিয়ে সদ্য বন্ধ করে রাখা— যেন কক্ষটির অস্তিত্বই গোপন রাখা হয়। তড়িঘড়ি করে তদন্তকারীরা যখন সেটি ভাঙলেন, বেরিয়ে এল এক বিভীষিকাময় জগৎ— গোপন এক জেলখানা। ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কয়েক কদম দূরের সামরিক একটি ঘাঁটিতে এই বন্দিশালা এমনভাবে গোপন ছিল যে, সন্দেহ না হলে হয়তো আর কখনো খুঁজে পাওয়া যেত না।

এই গোপন জেলটির অস্তিত্ব সামনে আসে মীর আহমদ বিন কাসেমসহ কিছু সাবেক বন্দির বর্ণনায়। সরকারবিরোধী কণ্ঠ হিসেবে পরিচিত কাসেম দীর্ঘ আট বছর এই জেলের অন্ধকার কক্ষে বন্দি ছিলেন। চোখ বাঁধা অবস্থায় তিনি প্রতিদিন যেভাবে শব্দ শুনতেন— বিশেষ করে বিমানের ওঠানামার আওয়াজ— সেইসব মনে রেখেই তিনি অনুমান করতে পেরেছিলেন জেলের অবস্থান।

মূল ভবনের পেছনের অংশে নির্মিত জানালাবিহীন, পাথর ও কংক্রিটের সেই কক্ষগুলোর কোনো আলো-হাওয়া ছিল না। সেগুলো যেন চোখের সামনেই আড়ালে ছিল। এতদিন যা শুধু গুজব ছিল, এখন তা পরিণত হয়েছে কঠিন বাস্তবতায়।

গত আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মুক্তি পান বহু বন্দি। তারা জানাচ্ছেন, দীর্ঘ সময় গোপন আটকের মধ্যে তাদের অনেককে হত্যা করা হয়েছে। তদন্তে উঠে এসেছে, এসব গোপন জেলখানা পরিচালিত হতো র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (RAB)-এর একটি এলিট ইউনিটের দ্বারা, যারা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (Sheikh Hasina)–র সরাসরি নির্দেশে কাজ করত।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম (Tajul Islam) বলেন, ‘যত গুম হয়েছে, সবই হাসিনার অনুমতি বা নির্দেশে হয়েছে।’ তবে আওয়ামী লীগ দাবি করে, এসব ঘটনা তাদের অজান্তে হয়েছে এবং তারা দায়ী নয়। সেনাবাহিনী এই দাবি মানছে না, বলেও জানানো হয়েছে।

মীর আহমদ বিন কাসেম এখন মুক্ত হলেও আতঙ্ক তাঁকে ছাড়েনি। বাইরে বেরোলে মুখ ঢেকে চলেন, বারবার পেছনে তাকান। ‘যদি আবার ধরে নিয়ে যায়? যেখানে ছিলাম, সেখানে কেউ যদি আর ফিরে না পায়?’— এ কথাগুলো আজও তাড়া করে তাঁকে।

গোপন জেলের ভিতরের বর্ণনা শুনলে গা শিউরে ওঠে। জানালাবিহীন, দুর্গন্ধযুক্ত, স্যাঁতসেঁতে এক অন্ধকার কক্ষে দিনরাত কেটেছে কাসেমের। গ্রীষ্মের তাপে দরজার নিচে মুখ রেখে হাওয়া নেয়ার চেষ্টা করতেন। “জীবন্ত কবরে” আটকে থাকার সেই অভিজ্ঞতা এখনও তাঁকে নি:শেষ করে দেয়।

এই একটি কেন্দ্র নয়— তদন্তকারীরা বলছেন, দেশজুড়ে এমন ৫০০ থেকে ৭০০টি গোপন সেল ছিল। সবগুলো ছিল একটি সুপরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের অংশ। আজও বহু মানুষ নিরুদ্দেশ, অনেকে নিখোঁজ, কেউ কেউ আতঙ্কে বাড়ি থেকেও বের হন না।

২৩ বছর বয়সী রহমতুল্লাহর কাহিনি যেন আরও একটি দলিল। ২০২৩ সালের ২৯ আগস্ট রাতের আঁধারে তাঁকে তার বাড়ি থেকে তুলে নেয় র‌্যাবের সদস্যরা। কিছু সদস্য ইউনিফর্মে, কেউ সাধারণ পোশাকে। তিনি তখন একটি শহরে বাবুর্চি হিসেবে কাজ করতেন এবং পাশাপাশি ইলেকট্রিক্যাল ট্রেনিং নিচ্ছিলেন।

রহমতুল্লাহ জানান, ভারতবিরোধী ও ইসলামপন্থী কিছু ফেসবুক পোস্টই তাকে টার্গেট করায়। বন্দি থাকা অবস্থায়, একটি ছোট ঘরের মধ্যে তাকে রাখা হয়— যেখানে একটি খোলা ড্রেনেই প্রাকৃতিক কাজ সারতে হতো। সেই ঘরে সোজা হয়ে পা ছড়িয়ে শুতে পারার জায়গাও ছিল না।

‘ঢাকার সেই জায়গার কথা মনে পড়লে আজও গা শিউরে ওঠে,’ বলেন রহমতুল্লাহ। ‘ওরা আমার দেড় বছর কেড়ে নিয়েছে। সেই সময় আমি কোনোদিন ফেরত পাব না।’

এই ভয়াবহ চিত্র সামনে এলেও এখনও পর্যন্ত কেউ বিচারের মুখোমুখি হয়নি। তবে যেসব ভুক্তভোগী এসব বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছেন, তারা চান– বিশ্ব জানুক কী হয়েছিল, এবং যেন ন্যায়বিচার হয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *