গণঅভ্যুত্থানের পরিণতি: ছাত্রনেতৃত্বের বিপথগামী যাত্রা ও গণআকাঙ্ক্ষার বিশ্বাসভঙ্গ

জুলাই মাসের গণ-অভ্যুত্থান দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন এক সম্ভাবনার সূচনা করেছিল। হাজার হাজার সাধারণ ছাত্র ও জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে শুরু হওয়া আন্দোলনটি অচিরেই জাতীয় চেতনার প্রতীক হয়ে ওঠে। স্বৈরাচারবিরোধী গণজোয়ারে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে খুনি ও লুটেরা স্বৈরশাসক হাসিনা (Hasina)-র পতন।

তবে ইতিহাসের এই মোড় ঘোরানো সময়ের পরেও প্রত্যাশিত গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা বাস্তবায়িত হয়নি। বরং, ৫ আগস্টের পরপরই আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা কিছু ছাত্রনেতা একটি কুচক্রী মহলের প্রভাবে বিপথগামী হয়ে পড়ে। তাদের লোভের কেন্দ্রবিন্দু ছিল অর্থ ও ক্ষমতা। এই গোষ্ঠী কেবল আন্দোলনের চেতনাকেই বিকৃত করেনি, বরং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানেও অনৈতিক কার্যকলাপ ছড়িয়ে দেয়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মূলধারার সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একাধিক অভিযোগে উঠে এসেছে, এই তথাকথিত নেতৃত্ব পার্সেন্টেজ বাণিজ্য, বদলি-পদোন্নতি নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগে কমিশন এবং টেন্ডার ভাগাভাগির মতো কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। এক সময় যারা ছিলেন গণআন্দোলনের চেতনার বাহক, তারা হয়ে ওঠেন প্রশাসনিক দালাল।

এই নেতৃত্বের কিছু সদস্য পরবর্তীতে পতিত স্বৈরশাসকের ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে তোলে রাজনৈতিক দল। বিলাসবহুল জীবন ও সাধারণ জনজীবন থেকে বিচ্ছিন্নতা তাদের গ্রহণযোগ্যতাকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। এরই ধারাবাহিকতায় গঠিত হয় ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’, যেটি একটি অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকারের ছায়ায় গড়ে ওঠলেও, গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের মাঝে স্থান করে নিতে ব্যর্থ হয়।

৫ আগস্টের পর থেকে এই গোষ্ঠীর অপতৎপরতা আরও ভয়ংকর রূপ নেয়। তারা ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে চালাতে থাকে পরিকল্পিত অপপ্রচার, চরিত্রহনন ও বিভ্রান্তিকর রাজনৈতিক তত্ত্বের চর্চা। এমনকি কখনো কখনো খেলাফত প্রতিষ্ঠার মতো চরমপন্থী ধারণাও তারা উস্কে দেয়। এর মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ধারাকে দীর্ঘায়িত করে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলের কৌশল নেয়।

সময়ের প্রবাহে স্পষ্ট হয়ে ওঠে—এই নেতৃত্ব আসলে কোনো আদর্শিক রাজনীতির প্রতিনিধি নয়। তারা এক ধরনের ক্ষমতা ও অর্থ-ভিত্তিক সিন্ডিকেটে পরিণত হয়। কেউ কেউ আবার গোয়েন্দা সংস্থার ছত্রছায়ায় দল গঠনের মাধ্যমে রাজনীতিকে ‘শেয়ারবাজার’-এ রূপান্তরিত করার চেষ্টা করে।

তবে একে শুধু ছাত্রনেতাদের দায় দিয়ে এড়ানো যায় না। এদের পিছনে থাকা তথাকথিত ‘বিপ্লবের গুরু’-দের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। তারা তরুণ প্রজন্মকে আদর্শবাদ নয়, বরং কৌশলী সুবিধাবাদের দিকে ঠেলে দেয়।

উস্কানিমূলক বক্তব্য, বিভাজনের রাজনীতি, চরিত্র হননের কুৎসিত খেলা এবং বিরোধী জোটে বিভ্রান্তি ছড়ানো—সবই এক বৃহৎ ষড়যন্ত্রের অংশ। যার মূল লক্ষ্য একটিই: অনির্বাচিত শাসনব্যবস্থার স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা।

এখন সময় এসেছে এই ষড়যন্ত্রকে চিহ্নিত করে, স্বচ্ছ নেতৃত্ব এবং গণতন্ত্রের পক্ষে শক্ত অবস্থান নেওয়ার।

ডাঃ ফেরদৌস কবির
সম্পাদক: তাজাখবর.কম

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *