টিআইবির চোখে ‘কিংস পার্টি’ এনসিপি—গভীর সংকটে নতুন রাজনৈতিক বিন্যাস

৫ আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)–কে সরাসরি ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন টিআইবির (Transparency International Bangladesh) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান (Dr. Iftekharuzzaman)। সোমবার (৪ আগস্ট) রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে “কর্তৃত্ববাদী সরকার পতন-পরবর্তী এক বছর: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি” শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে টিআইবি। সেখানেই উঠে আসে এই মন্তব্য।

সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে উত্তরে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “এটা গোপন করার কিছু নেই। এটি জাতীয় নাগরিক পার্টি, তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে যে কিংস পার্টি। কারণ, এর সঙ্গে সহযোদ্ধা বা সহযাত্রী হিসেবে যারা আছেন, তাদের মধ্যে দুজন সরকারে আছেন। সে হিসেবে এটা কিংস পার্টি।”

‘স্বচ্ছতা ও শুদ্ধতা’র বদলে আত্মঘাতী পথ

গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, এনসিপির বিকাশ রাজনৈতিক শুদ্ধতা ও দুর্নীতিবিরোধী শক্তি হিসেবে হওয়ার কথা থাকলেও, দলটি অর্থের উৎসের অস্বচ্ছতা, চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও দলবাজির সংস্কৃতি গ্রহণ করে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ফলে, দলটি এখন আত্মঘাতী পথে অগ্রসর হচ্ছে বলেই মন্তব্য করেছে টিআইবি।

গবেষণা ফেলো মো. জুলকারনাইন বলেন, “নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ, জোট গঠন, নতুন দলগুলোর আত্মপ্রকাশ দেখা গেছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের বাছাইয়ে কেউই শর্ত পূরণ করতে পারেনি, এনসিপিও ব্যর্থ হয়েছে।”

প্রতিদিন কোটি টাকার চাঁদাবাজি

টিআইবির প্রতিবেদনে ঢাকার ৫৩টি পরিবহণ টার্মিনাল ও স্ট্যান্ডে প্রতিদিন গড়ে ২ কোটি ২১ লাখ টাকা চাঁদাবাজির তথ্য উঠে এসেছে। এছাড়া সিলেটের কোয়ারি, নদ-নদী, বাজার, সেতু, ঘাট, বালুমহাল, জলমহালের দখল ও নিয়ন্ত্রণ দখলদার গোষ্ঠীর হাতে চলে গেছে বলে দাবি করা হয়।

টিআইবির ভাষায়, “মব” তৈরি করে সড়ক অবরোধ, থানা ঘেরাও, আন্দোলনের নামে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানো হয়েছে। এনসিপিকে ঘিরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকেও রাজনৈতিক বিভাজন, মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব এবং ক্ষমতার লড়াই তৈরি হয়েছে।

‘অশুভ’ যাত্রা ও দখলবাজির সংস্কৃতি

টিআইবির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ৫ আগস্টের পরবর্তী রাজনীতির যাত্রাপথ ছিল ‘অশুভ’। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “সেই দিন বিকাল থেকেই পুরনো রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের একাংশ দলবাজি, চাঁদাবাজি, মামলা–বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ে। এসব অনিয়ম নিয়ন্ত্রণে উচ্চপর্যায় থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও তেমন কাজ হয়নি। নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর জন্মলগ্নেই এসব অনিয়মের সংস্কৃতি গ্রহণ আত্মঘাতী পথে ঠেলে দিয়েছে তাদের।”

গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, এ সময় ১১ মাসে (আগস্ট ২০২৪–জুন ২০২৫) ৪৭১টি রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন ১২১ জন, আহত হয়েছেন ৫,১৮৯ জন। সহিংসতার সঙ্গে ৯২% ঘটনায় জড়িত ছিল বিএনপি, ২২% আওয়ামী লীগ, ৫% জামায়াত এবং ১% ছিল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) (National Citizen Party)।

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও আশঙ্কার বার্তা

সংস্থাটি আরও সতর্ক করে বলেছে, নির্বাচন, সংস্কার, এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সহনশীলতার ঘাটতি আরও বেড়েছে। এর ফলে আগামী দিনে নির্বাচন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।

টিআইবির গবেষণা ফেলো শাহজাদা এম আকরাম ও ফারহানা রহমানও এই গবেষণাপত্রে সহ-উপস্থাপক ছিলেন।

সব মিলিয়ে, যে রাজনৈতিক নবযাত্রা ‘গণতন্ত্র, জবাবদিহি ও শুদ্ধতার’ প্রত্যয়ে শুরু হওয়ার কথা ছিল, সেটিই এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে এনসিপির উত্থান ও তাদের আচরণ প্রমাণ করে, রাজনৈতিক সংস্কৃতির মৌলিক পরিবর্তনের যে প্রত্যাশা ছিল, তা এখনো বহু দূরের স্বপ্ন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *