“নতুন বাংলাদেশের প্রথম পরীক্ষা” ফেব্রুয়ারির নির্বাচন: জাতির উদ্দেশে মুহাম্মদ ইউনূস

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) রাতে জাতির উদ্দেশে এক দীর্ঘ ও আবেগঘন ভাষণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস (Muhammad Yunus) আগামী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন। এই নির্বাচনকে তিনি “নতুন বাংলাদেশ” গড়ার প্রথম বড় পরীক্ষা বলে আখ্যা দেন।

ভাষণে তিনি ২০২৩ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমি স্মরণ করে বলেন, “গত বছরের এই দিনে আমাদের তরুণরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে যে বিপ্লব ঘটিয়েছে, তা আমাদের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়।” তিনি জুলাইয়ের শহীদ, আহত ও পঙ্গুদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান এবং তাদের অবদানের কথা স্মরণ করেন।

‘জুলাই সনদ’ ও সংস্কার কর্মসূচি

ড. ইউনূস বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের তিনটি দায়িত্ব—সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন। এর অংশ হিসেবে তারা ইতোমধ্যে রাষ্ট্রীয় সংস্কারে নানা উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছেন। ‘জুলাই সনদ’ নামে একটি ঐতিহাসিক দলিল চূড়ান্ত করার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এতে ৩০টিরও বেশি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, “এটি কেবল রাজনৈতিক দলিল নয়, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গঠনের ভিত্তিপ্রস্তর।”

তিনি জানান, জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের মাধ্যমে ১৬৬টি সুপারিশ পর্যালোচনা করে ১৯টি মৌলিক সংস্কারের বিষয়ে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য অর্জিত হয়েছে।

স্বৈরাচারী সরকারের বিচার, অর্থনীতি ও বৈদেশিক সম্পর্ক

প্রধান উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, “জুলাই-আগস্টের মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার বিচারকাজ দৃঢ়ভাবে এগিয়ে চলছে।” একইসঙ্গে তিনি বলেন, গত ১৬ বছরে দেশে যে অর্থ পাচার হয়েছে, তা ফিরিয়ে আনতে সরকার আন্তর্জাতিক আইনজীবী নিয়োগ করেছে এবং ইতোমধ্যে কিছু সম্পদ জব্দ করা হয়েছে।

অর্থনীতি নিয়ে তিনি বলেন, “যখন আমাদের সরকার দায়িত্ব নিয়েছিল, অর্থনীতি ছিল বিধ্বস্ত। কিন্তু আজ, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে, রেমিট্যান্স বৃদ্ধি, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ—সব ক্ষেত্রেই আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি।” তিনি জানান, চলতি অর্থবছরে রেকর্ড ৩০৩৩ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে, রপ্তানি বেড়েছে ৯ শতাংশ এবং টাকার মান বেড়েছে।

বন্দর উন্নয়ন ও পানিভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলার পরিকল্পনাও তুলে ধরেন তিনি। বঙ্গোপসাগরের অপার সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে কর্মসংস্থান ও অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচনের ঘোষণা দেন।

নির্বাচন হবে ‘ঈদের মতো উৎসব’

ড. ইউনূস বলেন, “২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে রমজানের আগে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।” এবার প্রবাসী ভোটারদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা হবে এবং নারী ভোটারদের জন্য কেন্দ্রগুলোতে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিনি বলেন, “নির্বাচনের দিন যেন ঈদের মতো হয়। সবাই বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাবে। এই নির্বাচন হবে নাগরিক অধিকারের উৎসব।”

তিনি অভিযোগ করেন, “একটি গোষ্ঠী নির্বাচনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে দেশ-বিদেশে সক্রিয়।” তবে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের অপচেষ্টা ব্যর্থ হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

নতুন যুগের শিক্ষা ও প্রযুক্তি-ভিত্তিক রাষ্ট্র

শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হল সংস্কার, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস, ই-লার্নিং, নারীবান্ধব অবকাঠামো এবং স্কুলে প্রযুক্তির প্রসার এখন সরকারের অগ্রাধিকারে রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতনগ্রেড উন্নীত করা, শিক্ষক নিয়োগ এবং দূরবর্তী এলাকায় অনলাইনে শিক্ষা সম্প্রসারণের পরিকল্পনাও তিনি তুলে ধরেন।

বিচার ও পুলিশ সংস্কারে বড় পদক্ষেপ

বিচার ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনতে বিচার বিভাগীয় সংস্কার ও নতুন ফৌজদারি কার্যবিধি প্রণয়ন করা হয়েছে। গ্রেপ্তার-আটক, রিমান্ড, চিকিৎসা ও জিডি সংক্রান্ত নিয়মে এসেছে পরিবর্তন। পুলিশের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে বডি-ক্যামেরা, জিপিএস, স্বচ্ছ কাচের জিজ্ঞাসাবাদ ঘর এবং মানবাধিকার সেল চালু করা হয়েছে।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও তথ্য নিরাপত্তা

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল এবং সাইবার নিরাপত্তা আইন সংশোধনকে তিনি “একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ” হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “এখন কেউ চাইলে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমেও সরকারের সমালোচনা করতে পারে, যা অতীতে ছিল অকল্পনীয়।”

ইন্টারনেটকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে, রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যান্ডউইডথ ব্যবস্থাপনায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।

প্রবাসীদের জন্য সুসংবাদ

তিনি জানান, ভিসা জটিলতা নিরসনে কাজ চলছে। আরব আমিরাত পুনরায় ভিসা চালু করেছে, মালয়েশিয়া মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা দিয়েছে, জাপানে ১ লাখ বাংলাদেশিকে পাঠানোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে সৌদি আরব, ওমান, জর্ডানে ‘ইরেগুলার’ প্রবাসীদের বৈধতা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

জাতির প্রতি আহ্বান

ভাষণের শেষ প্রান্তে ড. ইউনূস জাতির উদ্দেশে বলেন, “আগামী নির্বাচনে আমরা সবাই ভোট দেবো। কেউ বাদ যাবে না। সবাই যেন বলতে পারি—নতুন বাংলাদেশ গড়ার পথে আমি আমার ভোটটা দিয়েছিলাম।”

তিনি আরও বলেন, “জুলাই আমাদের আত্ম-আবিষ্কারের মাস। আসুন, এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে আমরা সবাই মিলেই নতুন বাংলাদেশের প্রথম বড় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *