বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর দক্ষতা হলো ভুক্তভোগী কার্ড খেলা—অর্থাৎ নিপীড়ন বা অন্যায়ের শিকার হওয়ার গল্পকে সহানুভূতিতে রূপান্তর করে তা রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা। এই কৌশলটি কেবলমাত্র নির্বাচনী রাজনীতিতে নয়, আন্দোলন, সংগঠন ও জনমত গঠনের ক্ষেত্রেও বহুবার দেখা গেছে। আর আশ্চর্যের বিষয় হলো, সম্পূর্ণ বিপরীত মতাদর্শ ও আদর্শের দুই রাজনৈতিক শক্তিই এই অস্ত্রটি সমান সাফল্যের সাথে ব্যবহার করেছে—একদিকে শেখ হাসিনা (Sheikh Hasina) নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াত-শিবির (Jamaat-Shibir)।
আওয়ামী লীগ দীর্ঘকাল ধরে রাজনৈতিক নির্যাতনের কাহিনীকে নিজেদের টিকে থাকার মূল শক্তি হিসেবে কাজে লাগিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, নির্বাসন, দমনপীড়ন—এসব ঘটনাকে তারা সাধারণ মানুষের আবেগে পৌঁছে দিতে পেরেছে এমনভাবে, যা শেষ পর্যন্ত দলটিকে পরিণত করেছে একটি শক্তিশালী ও দীর্ঘমেয়াদী ক্ষমতাধর রাজনৈতিক শক্তিতে। সহানুভূতি ও প্রতিশোধ—এই দুই আবেগকে একত্রে কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগ ধীরে ধীরে নিজেদের অবস্থানকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে, যা গত দেড় দশক ধরে পুরো দেশকে প্রভাবিত করে আসছে।
অন্যদিকে জামায়াতও ভিন্ন কৌশলে একই পথ অবলম্বন করেছে। ধর্মের আবেগকে কেন্দ্র করে নিজেদের উপর চালানো দমননীতিকে তারা “ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র” হিসেবে প্রচার করে সহানুভূতি আদায় করতে চেয়েছে। তাদের প্রচারণায় রাজনৈতিক দমন-পীড়নের কাহিনী ধর্মীয় নিপীড়নের গল্পে পরিণত হয়, আর সেই সমন্বয়কৃত আবেগই তাদের নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয় একধরনের বিকল্প শক্তি হিসেবে। ফলে দেখা যায়, রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার ময়দানে ধর্মব্যবসায়ী জামায়াত আবারও সহানুভূতির কার্ড খেলতে শুরু করেছে—যেখানে ধর্ম ও ভুক্তভোগিতা মিলেমিশে তৈরি করছে এক বিশেষ ধরনের রাজনৈতিক পুঁজি।
এর বিপরীতে বিএনপি (BNP) —যা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য জন্মের পর থেকেই ত্যাগ স্বীকার করেছে—সে দলটি সহানুভূতির এই রাজনৈতিক শক্তি প্রত্যাশিতভাবে ব্যবহার করতে পারেনি, কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবেই করতে চায়নি। বারবার আন্দোলন, আত্মত্যাগ এবং দমন-নিপীড়নের ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও তারা জনমানসে সেই ত্যাগকে ভোটে বা দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক সমর্থনে রূপ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আজ বিএনপির সমর্থক মহলের অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, তাদের এই ধারাবাহিক ব্যর্থতা আসলে দলের রাজনৈতিক কৌশলগত দুর্বলতারই বহিঃপ্রকাশ কিনা।
তবে এখানেও একটি বড় বাস্তবতা আছে। সহানুভূতি-নির্ভর রাজনীতি অনেকটা মরীচিকার মতো। তা সাময়িক আবেগ তৈরি করতে পারে, কিছু মুহূর্তের জন্য জনসমর্থনও আদায় করতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এর কোনো স্থায়ী সমাধান বা ইতিবাচক প্রভাব নেই। দেশের জন্য তা খুব কমই কল্যাণ বয়ে আনে।
ফলাফল হিসেবে আজ আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি—ভুক্তভোগী কার্ডের সুচতুর ব্যবহার আওয়ামী লীগ ও জামায়াতকে শুধু রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী করেই রাখেনি, বরং দেশকে ঠেলে দিয়েছে এক অনিশ্চিত খাদের কিনারায়। তাদের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ও ক্ষমতায় টিকে থাকার অন্যতম মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে ভুক্তভোগিতাকে দক্ষতার সাথে রাজনৈতিক অস্ত্রে রূপান্তর করার ক্ষমতা।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—এই মরীচিকা-নির্ভর রাজনীতির স্থায়িত্ব কতদিন? আবেগ-নির্ভর সহানুভূতির খেলা সাময়িকভাবে জনমতকে প্রভাবিত করতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তা জাতির জন্য কোনো স্থায়ী সমাধান এনে দেয় না। বরং রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে দুর্বল করে, রাষ্ট্রকে বারবার সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করায়।
এখন তাই মূল চ্যালেঞ্জ হলো—জাতীয়তাবাদের চেতনায় বিশ্বাসী শক্তিগুলো কীভাবে এই মরীচিকার প্রভাব কাটিয়ে ওঠবে এবং দেশকে আবেগনির্ভর প্রতিশোধ-রাজনীতি থেকে মুক্ত করে একটি বাস্তবমুখী ও গঠনমূলক রাজনৈতিক ধারায় এগিয়ে নেবে।
ডাঃ ফেরদৌস কবীর
সম্পাদক , তাজাখবর