পার্বত্য চট্টগ্রামে আবারও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করছে ভারতীয় মদতপুষ্ট সশস্ত্র সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (United People’s Democratic Front – ইউপিডিএফ)। ধর্ষণের নাটক সাজিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উসকে দেওয়া, ভারতীয় ক্যাম্প থেকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে পাহাড়ে হামলা চালানো, পাশাপাশি চাঁদাবাজি ও অপহরণের মতো অপরাধে সরাসরি জড়িয়ে পড়েছে সংগঠনটির সদস্যরা। নিরাপত্তা বাহিনীর মতে, পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা পালানোর পর ভারত আবারও অস্থিরতা ছড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দিতে চাইছে।
এমন প্রেক্ষাপটে পাহাড়ে দায়িত্বে থাকা সেনা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অন্তত আড়াইশ নতুন সেনা ক্যাম্প স্থাপন ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। তাদের যুক্তি, নতুন ক্যাম্প হলে প্রতিটি রুটে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানানো সম্ভব হবে, অস্ত্র প্রবাহ বন্ধ করা যাবে, একই সঙ্গে চাঁদাবাজি ও অপহরণও প্রতিহত হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা বলেন, শান্তিচুক্তির পর ক্যাম্প কমে যাওয়ায় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করেছে এবং এখন প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ড, অপহরণ ও চাঁদাবাজি চালাচ্ছে।
গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী, শুধু গত এক বছরেই পাহাড়ের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা চাঁদা তুলেছে। এর মধ্যে ইউপিডিএফ একাই তুলেছে ১০৪ কোটি টাকা। রাঙামাটি জেলা থেকে ২৪৪ কোটি, খাগড়াছড়ি থেকে ৮৬ কোটি এবং বান্দরবান থেকে ২০ কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে। এ তালিকায় সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী, কৃষক, যানবাহন, ঠিকাদার, কাঠ, বাঁশ—এমনকি অপহরণের মতো ঘটনাও যুক্ত।
অপহরণ ও হত্যার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে নেই ইউপিডিএফ। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত তারা ৩৩২ জনকে অপহরণ করেছে, যাদের মধ্যে পাহাড়িরাও রয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থীকে অপহরণের ঘটনাও তাদের বিরুদ্ধে ওঠে। একই সময়ে অন্তত ৮৯ জন হত্যার শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে সেনাবাহিনীরও ১৬ সদস্য রয়েছেন। সেনাদের দাবি, ইউপিডিএফ এবং তাদের সহযোগীরা ভারতের মিজোরামে থাকা ক্যাম্প থেকে সরাসরি প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র নিয়ে এসে বাংলাদেশে নাশকতা চালাচ্ছে।
বর্তমানে খাগড়াছড়িতে ৯০, রাঙামাটিতে ৭০ এবং বান্দরবানে ৫০টি মিলে মোট ২১০টি সেনা ক্যাম্প থাকলেও পাহাড়ের ভৌগোলিক বাস্তবতায় তা পর্যাপ্ত নয়। সেনা কর্মকর্তারা মনে করেন, অন্তত আড়াইশ নতুন ক্যাম্প স্থাপন করা গেলে সন্ত্রাসীরা আর মাথা তুলতে পারবে না।
হাসিনার আমলে সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রতি নমনীয়তা
সেনা সদর সূত্র জানায়, শেখ হাসিনার সময়ে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রতি নমনীয় থাকার অলিখিত নির্দেশ ছিল। রাজনৈতিক মদত ও প্রশাসনিক শৈথিল্যের সুযোগে তারা আরও শক্তিশালী হয়। কিন্তু এখন নীতি পরিষ্কার—‘নো কম্প্রোমাইজ’। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কোনো আলোচনা নয়, কেবল সরাসরি অ্যাকশনই একমাত্র পথ। কারণ, এসব গোষ্ঠী কখনো সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি নয়; বরং পাহাড়ি ও বাঙালি উভয় সম্প্রদায়কেই জিম্মি করে রেখেছে।
সেনা কর্মকর্তাদের সতর্কবার্তা
একজন ব্রিগেড কমান্ডার বলেন, ইউপিডিএফ ও অন্যান্য গোষ্ঠী এখন শুধু চাঁদাবাজি বা অপহরণে সীমাবদ্ধ নেই; তারা সরাসরি ভারতীয় মিজোরাম থেকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র এনে পাহাড়ে হামলা চালাচ্ছে। তাই সীমান্তবর্তী দুর্গম এলাকায় ক্যাম্প বাড়ানো অপরিহার্য। খাগড়াছড়ি জোনের এক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, যেমনভাবে মিথ্যা ধর্ষণের নাটক সাজানো হয়েছে, সামনে আরও বড় কোনো ষড়যন্ত্র ঘটতে পারে।
বান্দরবানের দায়িত্বে থাকা এক মেজর জানান, ইউপিডিএফের চাঁদাবাজি ও হত্যার তথ্য সেনাদের হাতে আছে। তাদের কর্মকাণ্ড ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রত্যক্ষ সহায়তায় চলছে। প্রতিটি রুট চিহ্নিত করা হয়েছে। নতুন ক্যাম্প হলে সেনারা এক ঘণ্টার মধ্যেই যে কোনো এলাকায় অভিযান চালাতে পারবে। একইভাবে রাঙামাটির এক জোন কমান্ডার জানান, গোয়েন্দা প্রমাণ অনুযায়ী ইউপিডিএফের অন্তত ছয়টি ক্যাম্প ভারতের মিজোরামে রয়েছে। সীমান্ত পাহাড়ে অতিরিক্ত ক্যাম্প ছাড়া এ অনুপ্রবেশ ঠেকানো সম্ভব নয়।
খাগড়াছড়ির ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হাসান মাহমুদ বলেন, নতুন ক্যাম্প স্থাপন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারভুক্ত বিষয়। সেনারা তাদের সীমিত সক্ষমতা দিয়ে নজরদারি করছে। তিনি অভিযোগ করেন, ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইউপিডিএফ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উসকে দেওয়ার চেষ্টা করছে, যেখানে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের দিয়ে দেশীয় ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। তবে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মত
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাসী তৎপরতা, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও হত্যাকাণ্ড ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে। তাই ক্যাম্প প্রত্যাহারের প্রশ্নই ওঠে না। বরং আমাদের নিজেদের কৌশল অনুযায়ী এগিয়ে যেতে হবে। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শহীদুজ্জামানও মনে করেন, ইউপিডিএফ এবং অন্যান্য গোষ্ঠী ভারতের মিজোরাম ও ত্রিপুরা থেকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে, যা দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য গুরুতর হুমকি। তাই আড়াইশ নতুন সেনা ক্যাম্প স্থাপন একান্ত জরুরি। এসব ক্যাম্প হলে সেনারা দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে পারবে এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রম কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।