বিবিসি সাক্ষাৎকারে তারেক রহমানের পরিণত ও বাস্তবধর্মী উপস্থাপনা—নতুন ধারার রাজনীতির সূচনা

বিবিসি (BBC)-এর সঙ্গে তারেক রহমান (Tarique Rahman)-এর সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারটি রাজনৈতিক মহলে নতুন আলোচনা তৈরি করেছে। দীর্ঘ সময় পর ক্যামেরার সামনে আসা বিএনপি নেতা এই সাক্ষাৎকারে এমন স্বচ্ছ ও সংযত উপস্থিতি দেখিয়েছেন, যা অনেকের কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে।

দেখা গেছে, অন্য রাজনীতিকদের মতো বাগাড়ম্বর, মিথ্যা আশ্বাস বা মুখস্থ করা কৃত্রিম ভাষা নয়—তার বক্তব্যে ছিলো একধরনের সততা ও স্বচ্ছতার ছাপ। কোনো অতিরঞ্জন নয়, নেই কর্তৃত্ববাদী সুরও। বরং তার কথায় প্রতিফলিত হয়েছে এক ধরনের জেনুইন, মেথডিক্যাল চিন্তাভাবনা ও বাস্তবিক দৃষ্টিভঙ্গি। আজকে তার এমন সাক্ষাৎকারে অনেকেই তার মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন তার পিতার প্রতিচ্ছবি।

সাক্ষাৎকারে পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির প্রশ্নে তারেক রহমানের উত্তর ছিলো বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশের এক সাধারণ রাজনৈতিক কর্মী যেভাবে সংগ্রাম, নিপীড়ন আর দুঃখের ভেতর দিয়ে গেছেন, তিনিও সেই পথেই হেঁটেছেন। অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর সন্তান হিসেবে তিনি কোনো আরামের পথে রাজনীতিতে আসেননি।

তারেক রহমানের জীবনে যে পরিমাণ নিপীড়ন, নির্যাতন ও মানসিক যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা আছে—তা বাংলাদেশের কোনো শীর্ষ নেতার সন্তানের ক্ষেত্রে বিরল। অল্প বয়সে পিতৃহারা হওয়া, দেশের বাইরে ১৭ বছর নির্বাসিত জীবন, বৃদ্ধা মাকে রেখে যাওয়া, মা’য়ের ওপর নির্যাতন দেখতে বাধ্য হওয়া—এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ছোট ভাইয়ের অকালমৃত্যু। এই দীর্ঘ ট্র্যাজেডি তাঁকে আজ এক পরিণত ও দৃঢ় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে।

তাঁর কথায় দলের সাধারণ কর্মীদের প্রতি সহানুভূতি ও আত্মীয়তা স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, “যে মা’কে রেখে এসেছিলাম, সেই মা আজ অসুস্থ। যে ভাই রেখে এসেছিলাম, সে আর নেই। যে ঘর রেখে এসেছিলাম, সেই ঘরটিও তছনছ।” এই বক্তব্য যেন হাজারো নির্যাতিত বিএনপি কর্মীর জীবনের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। নেতার সঙ্গে কর্মীর এই আত্মিক যোগই তাঁর নেতৃত্বকে আরও মানবিক করে তুলেছে।

প্রার্থী মনোনয়ন প্রসঙ্গে তারেক রহমানের বক্তব্যও ছিলো দলের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন, প্রার্থী নির্বাচনে দলীয় স্বার্থ নয়, বরং স্থানীয় জনগণের গ্রহণযোগ্যতাকেই অগ্রাধিকার দেয়া হবে। অর্থাৎ যিনি জনগণের কাছে সৎ ও কর্মঠ হিসেবে পরিচিত, তিনিই প্রার্থী হবেন—এখানে কোনো রাজনৈতিক ছাড় থাকবে না।

কিছু রাজনৈতিক পরিভাষা সাক্ষাৎকারে উঠে এলেও সেগুলো ছিলো গণতান্ত্রিক দলের কালেক্টিভ একাউন্টিবিলিটি বা যৌথ দায়বদ্ধতার অংশ। তিনি দেখিয়েছেন, সিদ্ধান্ত হবে দলের কাঠামোর ভেতরে, জনগণের মতামতের ওপর ভিত্তি করে—এমন মনোভাব তাঁর মধ্যে স্পষ্ট।

চাঁদাবাজি প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য ছিলো বাস্তব ও সরাসরি। তিনি স্বীকার করেছেন, বিএনপি থেকে হাজারো কর্মী বহিষ্কৃত হয়েছে, কিন্তু সবাই যে অপরাধী তা নয়। উদাহরণ টেনে তিনি বলেছেন, কেউ নিজের দখলকৃত জমি ফিরে পাওয়ার চেষ্টায় অভিযুক্ত হয়েছেন, কেউ পারিবারিক বিরোধে জড়িয়েও ‘চাঁদাবাজ’ হিসেবে চিত্রিত হয়েছেন। তবু তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, ক্ষমতায় গেলে দলীয় পরিচয়ে কেউ যদি অপরাধে লিপ্ত হয়, কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এই অবস্থান বিএনপির জন্য এক ইতিবাচক বার্তা বহন করে—যেখানে দল অপরাধীকে আশ্রয় না দিয়ে আইন ও ন্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে।

জামায়াত-বিএনপি সম্পর্ক নিয়েও তারেক রহমানের বক্তব্য ছিলো যুক্তিসঙ্গত। তিনি বিষয়টিকে তাঁর পিতা জিয়াউর রহমান (Ziaur Rahman)-এর মতোই বহুদলীয় রাজনীতির স্বাভাবিক প্রতিযোগিতা হিসেবে দেখেছেন। কোনো বিভাজন উস্কানো বা প্রতিহিংসামূলক মনোভাব তাঁর কথায় ছিলো না।

অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, জনগণই বিচার করবে। ইসলামী মূল্যবোধ ও ন্যায়বিচারের আদর্শে অবিচল থাকার অঙ্গীকারও করেছেন তিনি। তাঁর বক্তব্যে “ইনশাআল্লাহ” ও “আলহামদুলিল্লাহ”-এর মতো ধর্মীয় পরিভাষার ব্যবহার ছিলো সাবলীল ও অকৃত্রিম—যা তাঁর পারিবারিক রাজনৈতিক ঐতিহ্যেরই ধারাবাহিকতা।

জুলাই আন্দোলনের প্রসঙ্গে তিনি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের প্রশংসা করে আলাদা করে উল্লেখ করেছেন—যা তাঁর উদারতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন।

সবশেষে, দেখা গেছে—দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের প্রচারযন্ত্র যে নেতিবাচক চিত্র তৈরি করেছিল, সেইসব অভিযোগ ও প্রোপাগান্ডা এই সাক্ষাৎকারের পর ধুলিস্যাৎ হয়ে গেছে। এখন অবশিষ্ট যা রয়ে গেছে, তা শুধু রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ‘গাত্রদাহ’ বলেই মনে হয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *