‘সেফ এক্সিট’ অপমান নয়, রাজনৈতিক বাস্তবতা—গোলাম মাওলা রনির বিশ্লেষণ

রাজনীতিতে ‘পালিয়ে যাওয়া’ কোনো লজ্জার বিষয় নয়, বরং এটি যুগে যুগে ক্ষমতা রক্ষার কৌশলের অংশ—এমনই দাবি করেছেন সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক গোলাম মাওলা রনি (Golam Maula Rony)। রবিবার (১২ অক্টোবর) নিজের ইউটিউব চ্যানেলে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, রাজনীতির শুরু থেকেই শিখতে হয় কিভাবে ‘নিরাপদে’ পিছু হটা যায়, আজকের ভাষায় যেটিকে আমরা বলি ‘সেফ এক্সিট’।

তিনি বলেন, ইতিহাসের দিকে তাকালেও দেখা যায়, খোদ আলেকজান্ডারও একাধিকবার যুদ্ধে পিছু হটেছেন। তাই আজ যারা ‘পালিয়ে যাচ্ছে’ বলে সমালোচিত হচ্ছেন, তাদের নিয়ে বিদ্রূপ নয়—বরং এটা বুঝতে হবে, তারা একটি রাজনৈতিক চর্চার ধারাবাহিক অংশ হিসেবেই এমন পদক্ষেপ নিচ্ছেন।

রনি দাবি করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তিনি অন্তত আট থেকে দশবার ‘কখন পালাবেন, কিভাবে পালাবেন, কেন পালাবেন’ এই বিষয়ের ওপর কলাম লিখেছেন। তার ভাষায়, “আমি জানতাম একদিন পালাতে হবে, সেই বিশ্বাসেই সেগুলো লিখেছি। আমি বিশ্বাস করি, অনেক নেতা সেগুলো পড়েছেন।”

তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক কাঠামোতে এক সময় ‘সেফ এক্সিট’ বিষয়টি প্রশিক্ষণের অংশ ছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন জয়লাভ জরুরি, তেমনি পরাজয়ের পর নিরাপদে সরে গিয়ে ভবিষ্যতের জন্য শক্তি সঞ্চয় করাও ছিল বুদ্ধিমত্তার কাজ। সেই ঐতিহ্য আজও রাজনীতিতে বর্তমান।

রনি আরও দাবি করেন, “আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনের পতন ঘটেছে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে।” এরপর বিভিন্ন নেতা পালিয়ে গেছেন এবং তাদের পালানোর পন্থা ছিল বিস্ময়কর—কারো নৌকায়, কেউ পাহাড় ডিঙিয়ে, আবার কেউ প্লেন বা হেলিকপ্টারে। আজ ভারতের গলি থেকে শুরু করে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া কিংবা দুবাই—প্রায় সবখানেই নাকি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের দেখা যাচ্ছে। তার ভাষায়, “তাদের একধরনের বিশাল প্রস্তুতি ছিল।”

বর্তমানে ‘সেফ এক্সিট’ নিয়ে সমাজে তীব্র বিতর্ক চলছে বলে উল্লেখ করেন রনি। কারও মতে, পালিয়ে যাওয়া হচ্ছে একমাত্র বাঁচার উপায়, অন্যরা বলছেন, তাঁরা দেশেই থেকে যাবেন। তিনি বলেন, ওবায়দুল কাদের ও শেখ হাসিনাও স্পষ্টভাবে বলেছেন, তাঁরা পালাবেন না।

তবে রনি মনে করিয়ে দেন, “রাজনৈতিক চরিত্র সম্পর্কে জনগণের বিশ্বাস হলো, তারা কথা দিলে তা রাখতে পারে না। রাজনীতিতে কোনো চূড়ান্ত কথা নেই।” বর্তমানে যারা ক্ষমতায় আছেন, তারা হয়তো মূলত রাজনীতিক নন, তবে তারা ‘পলিটিক্যাল চেয়ার’-এ বসে থাকায় তাদের পরিণতিও রাজনীতিকদের মতোই হবে।

এনসিপি (NCP) নেতাদের মধ্যেও এ বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। দলের প্রথম সারির নেতা সারজিস আলম ঘোষণা দিয়েছেন, “তাদের কোনো সেফ এক্সিট নেই—একমাত্র এক্সিট হবে মৃত্যু।” অন্যদিকে দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম অভিযোগ করেছেন, কিছু উপদেষ্টা তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন, সম্পদের পাহাড় গড়েছেন এবং এখন পালানোর চেষ্টা করছেন—অর্থাৎ বাস্তবিক অর্থেই ‘সেফ এক্সিট’ নিচ্ছেন।

এই প্রসঙ্গে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান (Syeda Rizwana Hasan) প্রকাশ্যে বলেন, “আমি দেশ ছাড়ব না। পালাব না, কোনো সেফ এক্সিটও নেব না।” পাশাপাশি তিনি নাহিদ ইসলামকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বলেন, “আপনি স্পষ্ট করে বলুন, কোন কোন উপদেষ্টা সেফ এক্সিট নিতে চাইছেন?”

রনি বলেন, “পালানোর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। পৃথিবীর এমন কোনো বীর নেই যিনি জীবনে একবারও পালাননি। আলেকজান্ডারও বহুবার পিছু হটেছেন। তাই আজ যাদের বিরুদ্ধে পালানোর অভিযোগ উঠছে, তাদের অসম্মান করার কিছু নেই।”

তিনি আরও বলেন, “আওয়ামী লীগের যেসব মন্ত্রী বা এমপি সিক্রেট সার্ভিসের আওতার বাইরে ছিলেন, তারা পালাতে পারেননি—ধরা পড়েছেন। কিন্তু যাঁরা এই সিক্রেট সার্ভিসের আওতায় ছিলেন, তারা দেশের বাইরে নিরাপদে চলে গেছেন—আমরা কিছুই টের পাইনি। আমরা শুধু শেখ হাসিনার হেলিকপ্টারে ওঠা দেখেই উত্তেজিত হয়েছিলাম। কিন্তু শত শত নেতাকে পরিকল্পিতভাবে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, যেটিই আসলে ‘সেফ এক্সিট’। এটি ভবিষ্যতেও হবে, এটাই রাষ্ট্রের প্রক্রিয়া।”

শেষে তিনি বলেন, “কাদের ভাগ্যে সেফ এক্সিট আছে, কাদের নেই—এটা একমাত্র আল্লাহ জানেন। কেউ রাজকীয় সম্মানে বিদায় নেবেন, আবার কেউ জনতার লাথি-ঘুষি খেয়ে বিদায় নেবেন। সময়ই বলে দেবে কার জন্য কী অপেক্ষা করছে।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *