বাংলাদেশের অনুকূলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (IMF) ঋণের ষষ্ঠ কিস্তি ছাড়ে নতুন শর্ত আরোপ করেছে সংস্থাটি। আইএমএফ স্পষ্ট করে জানিয়েছে, নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত তারা ৮০ কোটিরও বেশি ডলারের এই কিস্তি ছাড় করবে না। ডিসেম্বরের আগে অর্থ ছাড়ের সম্ভাবনা কার্যত বাতিল বলে মনে করা হচ্ছে।
সম্প্রতি ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বার্ষিক সভার সাইডলাইনে বাংলাদেশ ব্যাংকের (Bangladesh Bank) গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সংস্থাটির প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হলে এই অবস্থান স্পষ্ট করে জানায় আইএমএফ। তাদের বক্তব্য, নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত নতুন সরকার সংস্কার কর্মসূচির প্রকৃত দায়িত্বপ্রাপ্ত হবে, তাই তাদের সঙ্গেই কিস্তি ছাড় নিয়ে চূড়ান্ত আলোচনা হবে।
ড. আহসান এইচ মনসুর এ বিষয়ে বলেন, “নীতিগত শর্ত পূরণ হলে ডিসেম্বরের মধ্যেই কিস্তি ছাড় হওয়ার কথা থাকলেও আইএমএফ এখন বলছে, তারা নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। তবে এই অর্থ এখন বাংলাদেশের জন্য একান্ত জরুরি নয়।”
তিনি আরও জানান, দেশের রিজার্ভ ভালো অবস্থানে আছে, ডলারের বাজার স্থিতিশীল এবং রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র মতে, রেমিট্যান্স প্রবাহ ১৬ শতাংশ বেড়েছে, রপ্তানি আয়ও জুলাই-সেপ্টেম্বরে গড়ে ৫.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২১৪ কোটি ডলারে। এমনকি চলতি হিসাবও ঘাটতি থেকে উদ্বৃত্তে ফিরে এসেছে।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ওয়াশিংটনে বলেন, “আইএমএফ যদি অতিরিক্ত কঠোর শর্ত আরোপ করে, তাহলে বাংলাদেশ তা মেনে নেবে না। দেশের অর্থনীতি এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে।”
অর্থনীতিবিদদের মতে, আইএমএফ সবসময়ই সংস্কার বাস্তবায়নে চাপ প্রয়োগের সুযোগ খোঁজে। নির্বাচনের আগে কিস্তি আটকে দিলে বর্তমান সরকারের আন্তর্জাতিক ইমেজ ক্ষুণ্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে—এ বিষয়টি ভালোভাবেই জানে সংস্থাটি। ফলে নতুন সরকারের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায়ের কৌশল হিসেবেই এমন অবস্থান নিয়েছে তারা।
প্রসঙ্গত, জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ফেব্রুয়ারিতে। নির্বাচনের পর গঠিত সরকারই হবে আইএমএফের পরবর্তী আলোচনার প্রধান পক্ষ।
আইএমএফের চাপ নতুন কিছু নয়। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের সময় মাত্র ১০০ কোটি ডলারের নিচে রিজার্ভ থাকায় কঠোর শর্তে ঋণ দিয়েছিল তারা। আবার ২০২২ সালের বৈশ্বিক মন্দার সময় বাংলাদেশ যখন ঋণ চায়, তখন সংস্থাটি আগেভাগেই শর্ত চাপায়—যেমন জ্বালানি তেলের দাম ৫২ শতাংশ বৃদ্ধি, গ্যাস ও সারের দাম বাড়ানো, এবং টাকার অবমূল্যায়ন। এসব পদক্ষেপের ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
বর্তমানে পাঁচ কিস্তিতে ৩৬০ কোটি ডলার ছেড়েছে আইএমএফ, এবং মোট অনুমোদিত ঋণ ৫৫০ কোটি ডলার। ষষ্ঠ কিস্তির অর্থ ছাড়ের জন্য আইএমএফের একটি মিশন ২৯ অক্টোবর ঢাকায় আসবে। দুই সপ্তাহের মধ্যে তারা শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি মূল্যায়ন করবে এবং এরপর প্রধান কার্যালয়ে প্রতিবেদন পাঠাবে। সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই ঋণের কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে।