“প্রতারণা করছে সরকার”— প্রায় সব দলেরই একই অভিযোগ

জুলাই বিপ্লব–পরবর্তী রাজনৈতিক আবহে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি শুরুতে যেভাবে নিরঙ্কুশ সমর্থন দেখিয়েছিল দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল, সেই চিত্র এখন নাটকীয়ভাবে পাল্টে গেছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকারকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত রাজনৈতিক বিভাজন এবং প্রতারণার অভিযোগে আস্থার ভরসা যেন দ্রুত ক্ষয়ে যাচ্ছে।

জামায়াত ও এনসিপি ব্যতীত প্রায় সব দলই সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অভিযোগ তুলেছে। কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ ও এর বাস্তবায়ন নিয়ে অস্পষ্টতা। এই পরিস্থিতিতে প্রতিশ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন উঠছে, উদ্ভূত অনিশ্চয়তায় দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ পড়ে গেছে ঘোলাটে স্রোতে।

সরকার ও ঐকমত্য কমিশনের বিরুদ্ধে ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ অভিযোগ বিএনপির
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরাসরি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দেশের জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তাঁর দাবি, নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজনের আর কোনো অবকাশ নেই। পাশাপাশি, কিছু মহল নির্বাচনী প্রক্রিয়া বিলম্বিত করতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

‘প্রতারণা করছে সরকার’—মাহমুদুর রহমান মান্নার আক্ষেপ
নাগরিক ঐক্য সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, “বর্তমানে দেশ গভীর সংকটে রয়েছে। সরকার জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করছে।” তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, যে সরকার নির্বাচন আয়োজন করবে, যদি সেই সরকারই প্রতারক হয়, তবে ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। সংকট সমাধানে দ্রুত নির্বাচন ছাড়া কোনো পথ নেই বলেই মনে করেন তিনি।

‘ঐকমত্যের নামে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে’—সিপিবির অভিযোগ
সিপিবি নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, অন্তর্বর্তী সরকার ‘ঐকমত্য’-এর নামে একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চাইছে। তাঁর দাবি, সরকার কাঠামোর ভেতরে একটি নির্দিষ্ট দল প্রভাব বিস্তার করছে, যার ইচ্ছা অনুযায়ী চলছে সিদ্ধান্ত গ্রহণ।

তিনি বলেন, দেশে এখন গণতন্ত্র তো দূরের কথা, বৈষম্য চরমে পৌঁছেছে। এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে ফেব্রুয়ারিতেই জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের আহ্বান জানান তিনি। একইসঙ্গে বলেন, সরকার যে গণভোট আয়োজন করতে চাইছে, তা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়।

জোনায়েদ সাকির আশঙ্কা: ফ্যাসিস্টদের প্রবেশের সুযোগ তৈরি হচ্ছে
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, “সংবিধান বা সংস্কার—কোনোটিই টেকসই হয় না জনগণের নির্বাচিত পার্লামেন্ট ছাড়া।” তাঁর মতে, কোনো একক দল রাষ্ট্রের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না, বরং সংঘাত ডেকে আনবে।

তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে দেশি-বিদেশি ফ্যাসিস্ট শক্তি ও শেখ হাসিনা এই অর্জন ধ্বংস করার সুযোগ পেয়ে যাবে। এজন্য প্রয়োজন ন্যূনতম জাতীয় ঐকমত্য।

‘সনদ অপরিবর্তনীয়’—গণঅধিকার পরিষদের অবস্থান
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খাঁন স্পষ্ট করে বলেন, “যে লেখায় স্বাক্ষর হয়েছে, সেই অনুযায়ীই বাস্তবায়ন হবে। নতুন করে কিছু পরিবর্তনের সুযোগ নেই।” তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ আবেগ দিয়ে চলে না। কেউ স্বাক্ষর না করলেও, অন্যদের সঙ্গে প্রতারণা করা চলবে না।

‘স্বৈরাচার সরে যায়, আবার ফিরে আসে’—এবি পার্টির হতাশা
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, “আমরা বারবার স্বৈরাচার সরাই, আবার আমাদের মধ্য থেকেই নতুন স্বৈরাচার জন্ম নেয়।” তিনি বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পর আশা ছিল নতুন ধরনের রাজনীতির উত্থান ঘটবে, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।

‘জুলাই সনদের নামে বিভাজন তৈরি হচ্ছে’—নুরুল হক নুরের অভিযোগ
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, জুলাই সনদের নামে রাজনীতিতে বিভাজন তৈরি হচ্ছে। তিনি বলেন, নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে সব দলের প্রার্থীরা এখন মাঠে থাকলেও এই বিভাজন অটুট থাকলে নির্বাচনী প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে, যথাসময়ে নির্বাচনও নাও হতে পারে।

সর্বশেষ পরিস্থিতিতে স্পষ্ট, অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে রাজনৈতিক আস্থার ভীত নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলো এখন সরাসরি সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছে। প্রতারণা, অস্বচ্ছতা এবং একপাক্ষিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের অভিযোগে রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়ছে। ফলে, বহুল প্রতীক্ষিত জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও তীব্র হয়ে উঠছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *