যদি আগামী সপ্তাহেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি (BNP)-কে ভোট দেবেন ৩০ শতাংশ ভোটার, আর জামায়াতে ইসলামি (Jamaat-e-Islami)-কে ভোট দেবেন ২৬ শতাংশ। দুই দলের মধ্যে ব্যবধান মাত্র ৪ শতাংশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত, রিপাবলিকান পার্টি-ঘনিষ্ঠ অলাভজনক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (International Republican Institute – IRI)-এর এক সাম্প্রতিক জরিপে উঠে এসেছে এই তথ্য।
আইআরআই-এর ‘সেন্টার ফর ইনসাইটস ইন সার্ভে রিসার্চ’-এর হয়ে জরিপটি পরিচালনা করেছে একটি স্থানীয় প্রতিষ্ঠান। ২০২৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত ৬৩টি জেলা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়, যেখানে সরাসরি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় সিএপিআই পদ্ধতিতে। মোট ৪,৯৮৫ জন ১৮ বছরের ঊর্ধ্ব বয়সী নাগরিকের মতামত নেওয়া হয়েছে। জরিপে আস্থার পরিমাণ ধরা হয়েছে ৯৫ শতাংশ, সম্ভাব্য বিচ্যুতি ১.৪ শতাংশ।
ভোটের অনুপাত অনুযায়ী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) (NCP) পাচ্ছে ৬ শতাংশ ভোট, জাতীয় পার্টি (Jatiya Party) পাচ্ছে ৫ শতাংশ এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ পাচ্ছে ৪ শতাংশ ভোট। অন্যদিকে, অন্যান্য দল মিলে পাচ্ছে ৮ শতাংশ ভোট।
এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের আইআরআই-এর সিনিয়র পরিচালক জোহান্না কাও বলেন, “ড. ইউনূসের নেতৃত্বে জনগণ অগ্রগতির সম্ভাবনা দেখছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আস্থা সমাজে স্থিতিশীলতা, জবাবদিহি ও সংস্কারের গভীর প্রত্যাশার প্রতিফলন।” কাও আরও বলেন, “ভোটারদের এই আগ্রহ প্রমাণ করে সংস্কার এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম।” জরিপে দেখা যায়, ৬৬ শতাংশ ভোটার জানিয়েছেন তাঁরা ‘খুবই আগ্রহী’ ভোট দিতে। ২৩ শতাংশ বলেছেন, ‘কিছুটা আগ্রহী’। এ ছাড়া ৮০ শতাংশ বিশ্বাস করেন, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে চুক্তি বাস্তবায়নে স্থবিরতা
তবে জাতীয় রাজনীতির উত্তাপের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি (Chittagong Hill Tracts Accord) বাস্তবায়নের অনিশ্চয়তাও নতুন করে দৃষ্টিগোচর হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, জেলা পুলিশ ও ভূমি দপ্তর জেলা পরিষদের অধীনে যাওয়ার কথা থাকলেও ২৮ বছরেও তা হয়নি। রাঙামাটিতে জেলা পরিষদ নির্বাচন না হওয়ায়, সরকারের মনোনীত ব্যক্তিরা অন্তর্বর্তীকালীনভাবে দায়িত্ব পালন করছেন, যা গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের অভাব তৈরি করছে।
রাঙামাটি জেলা পরিষদের সদস্য হাবিব আজম বলেন, “নির্বাচন না হওয়ায় আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। ১৫ জন সদস্য দিয়ে ৩৪ সদস্যের কাঠামো চালানো হচ্ছে, এটা পর্যাপ্ত নয়।” স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক তনয় দেওয়ান মনে করেন, “শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্ষমতার দ্বন্দ্বে চুক্তির অনেক দিক থমকে গেছে। বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে ক্ষমতায় আনতে না পারলে চুক্তির সুফল মিলবে না।”
চুক্তির বৈধতা নিয়েও আদালতে রয়েছে মামলা। ২০১০ সালে হাইকোর্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইনকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে। পরে সরকার আপিল করলে এখন তা সুপ্রিম কোর্ট (Supreme Court)-এ বিচারাধীন। আইনজীবী নিকোলাস চাকমা বলেন, “চুক্তিকে হাইকোর্ট বৈধ বললেও আঞ্চলিক পরিষদকে সাংবিধানিক নয় বলেছে। এই অবস্থানে আদালতের রায় চুক্তির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।”
২০০১ সালে তৈরি হওয়া ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনও আজ পর্যন্ত কোনো বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারেনি। ২০১৬ সালে আইন সংশোধন হলেও কার্যকারিতা আসেনি। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহসভাপতি ঊষাতন তালুকদার বলেন, “কোনো সরকারই রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখায়নি। আমাদের দাবি, বর্তমান বা পরবর্তী সরকার যেন চুক্তি বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেয়।”
অস্ত্রের ছায়ায় অস্থিরতা
রাজনৈতিক উত্তাপের পাশাপাশি উদ্বেগ বাড়াচ্ছে অপরাধ ও অস্ত্রের ছায়া। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যমতে, জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর জামিনে ছাড়া পেয়েছে ১৭৪ জন আসামি, যাদের মধ্যে ১১ জন চিহ্নিত শীর্ষ সন্ত্রাসী। তাদের মধ্যে রয়েছে সুইডেন আসলাম, ইমন, পিচ্চি হেলাল, ফ্রিডম রাসু, আব্বাস আলী ও টিটন। অনেকে মুক্তির পর ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে, পুরোনো অনুসারীদের সংগঠিত করছে।
সূত্র জানায়, সুব্রত বাইন গ্রেপ্তারের পর জিসান গ্রুপ রাজধানীর মগবাজার থেকে মহাখালী পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করছে। ইমনের অনুসারীরা মোহাম্মদপুর ও ধানমন্ডিতে সক্রিয়। বিদেশে থাকা চট্টগ্রামের অপরাধী বড় সাজ্জাদ গত আগস্ট থেকে ১০টি হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে পুলিশ দাবি করেছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত র্যাব উদ্ধার করেছে ২১৯টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং গ্রেপ্তার করেছে ১১২ জনকে। বিজিবি (BGB) জানিয়েছে, বছরের প্রথম ১০ মাসেই উদ্ধার হয়েছে ১,৩৭৭টি অস্ত্র।
সীমান্তবর্তী টেকনাফ, বেনাপোল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর ও মেহেরপুর দিয়ে আসছে অধিকাংশ অস্ত্র। সর্বশেষ যশোরে ৫টি বিদেশি পিস্তল ও ৫০টি গুলি জব্দ করেছে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ।
এদিকে, পুলিশের ৫ আগস্টের অস্ত্র লুটের ঘটনায় ৫০০টিরও বেশি অস্ত্র এখনো নিখোঁজ, ধারণা করা হচ্ছে সেগুলো সন্ত্রাসীদের হাতে পৌঁছেছে।
ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী দাবি করেছেন, ঢাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে, ছিনতাই ও প্রকাশ্যে হামলার সংখ্যা কমেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, জামিনে ছাড়া পাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীরা রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় নতুন করে সংঘবদ্ধ হচ্ছে।
ক্রিমিনোলজি বিশেষজ্ঞ ওমর ফারুক বলেন, “এই সন্ত্রাসীদের এখনই গ্রেপ্তার ও অস্ত্র উদ্ধার না করলে নির্বাচনের পরিবেশ শান্ত রাখা কঠিন হবে।”


