এনসিপি’র ভেতরেই দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা ও হতাশা, ভেঙে পড়ছে নতুন রাজনীতির স্বপ্ন

রেহমান সোবহান (Rehman Sobhan) সম্প্রতি এক নিবন্ধে বলেছেন, “রাজনীতির চিরন্তন শিক্ষা হলো সঠিক সময়ে সঠিক লড়াই করা।” তার মন্তব্য আজকের ছাত্র আন্দোলন থেকে গড়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি (National Citizen Party – NCP) এর বাস্তবতায় মর্মান্তিকভাবে মিলে যাচ্ছে। ৭ মাস আগেও যারা গণমানুষের আস্থার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন, তারাই এখন নেতৃত্বহীনতা, স্বজনপ্রীতি, আর্থিক অস্বচ্ছতা ও পুরনো ধাঁচের রাজনীতিতে জড়িয়ে জনগণের হতাশার প্রতীক হয়ে উঠছেন।

কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তন, এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের অংশগ্রহণ— ছাত্রনেতাদের উত্থান ছিল নায়কোচিত। তখনই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘নতুন রাজনীতির’ অঙ্গীকারে গড়ে ওঠে জাতীয় নাগরিক কমিটি, পরে ফেব্রুয়ারিতে আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ করে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি।

তবে, সেই প্রতিশ্রুত ‘নতুন রাজনীতি’ আজ প্রশ্নবিদ্ধ। এনসিপির বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা জড়িয়ে পড়েছেন নিয়োগ বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের অভিযোগে। যেমন, যুগ্ম সদস্য সচিব গাজী সালাহ উদ্দিন তানভীর (Gazi Salahuddin Tanvir) এর বিরুদ্ধে ঘুষ বাণিজ্য ও সরকারি কাজে প্রভাব খাটানোর অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ আমলে না নিয়ে পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি ছড়িয়ে পড়ার পর তাকে সাময়িক অব্যাহতি দেয় দল।

তানভীরের মতো আরও বিতর্কিত নাম উঠে এসেছে— সারজিস আলম (Sarjis Alam), হাসনাত আব্দুল্লাহ (Hasnat Abdullah), নুসরাত তাবাসসুম (Nusrat Tabassum) এবং আব্দুল হান্নান মাসুদ (Abdul Hannan Masud)। মাস্টাররোলে কর্মী নিয়োগ, দুর্নীতির অভিযোগ, সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনৈতিক যোগাযোগ—এসব ঘটনায় নতুন রাজনীতির স্বপ্ন দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

তরুণ নেতৃত্বের পাশাপাশি এনসিপিতে প্রবলভাবে ফুটে উঠছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, সিদ্ধান্তহীনতা ও আর্থিক অস্বচ্ছতা। দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে সভায় সরাসরি অভিযোগ উঠেছে। এনসিপি’র ১৪ ঘণ্টার দীর্ঘ সাধারণ সভায় নেতারা স্বীকার করেছেন— সংগঠনের ৬০% রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে অভ্যুত্থানের সময়কার এক শীর্ষ ছাত্রনেতার ছায়া নেতৃত্ব নিয়ে গভীর অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।

নাহিদ ইসলাম (Nahid Islam) এবং সদস্য সচিব আখতার হোসেনের নেতৃত্ব নিয়ে অসন্তুষ্টি রয়েছে তৃণমূলেও। অর্থাৎ দল চালানোর জন্য যে দূরদর্শিতা ও দক্ষতা প্রয়োজন ছিল, তা দৃশ্যমান নয়। জেলা-উপজেলা কমিটির আহ্বায়ক পদে ৪০ বছরের ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তরুণদের রাজনীতির দল হওয়া সত্ত্বেও এমন সিদ্ধান্ত সংগঠনের মূল আদর্শের সঙ্গেই সাংঘর্ষিক।

এদিকে, দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণেও অস্বচ্ছতা স্পষ্ট। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের অভিযোগ, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এককভাবে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। আর্থিক স্বচ্ছতার অভাব নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন।

এছাড়া, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের সাবেক নেতাদের ঘিরে বিস্তর অনিয়মের খবর প্রকাশ পাচ্ছে। যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের এপিএস মোয়াজ্জেম হোসেন ও স্বাস্থ্য উপদেষ্টার এপিএসকেও অনিয়মের দায়ে পদচ্যুত করা হয়েছে।

এসব ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে, ‘নতুন রাজনীতি’র অঙ্গীকার আর বাস্তবতা এক নয়। ফেসবুক ব্যবহারেও নেতাদের অবিবেচক মন্তব্য সংগঠনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। তাই নিয়ন্ত্রণের জন্য শৃঙ্খলা ও তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ (Mohiuddin Ahmad) যথার্থই বলেছেন, “এই ছাত্রনেতাদের বয়স কম, কিন্তু তাদের ম্যাচিউরিটি প্রয়োজন। না হলে প্রতিপক্ষরা এ ভুলের সুযোগ নেবে।”

পরিশেষে, আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম আশাবাদী হয়ে বলেছেন, “পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপাদান আমাদের ভেতরও আসার চেষ্টা করছে। তবে আমরা জবাবদিহির আওতায় আনছি।” কিন্তু বাস্তবতা বলছে— আত্মপ্রবঞ্চনাহীন আত্মসমালোচনা, দৃঢ় নেতৃত্ব এবং নীতি-ভিত্তিক সংগঠন গড়ার সক্ষমতা ছাড়া এনসিপি’র পথচলা কঠিন হবে। না হলে ‘নতুন রাজনীতি’র মোড়কে পুরনো ধারা অব্যাহত থাকবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *