বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মাহফুজ আলম (Mahfuz Alam) এক ব্যতিক্রমী চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। যখন ভারতের নীতিগত হস্তক্ষেপ এবং জামায়াতে ইসলামীর (Jamaat-e-Islami) প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্যকে প্রভাবিত করছে, তখন মাহফুজ আলম সরাসরি উভয়ের বিরুদ্ধেই দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন। তার স্পষ্ট বক্তব্য বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের পক্ষে, এবং তিনি কোনোভাবেই অতীতের যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি সহনশীল নন।
ভারতের ভূরাজনৈতিক ছায়া ও জামায়াতের সুবিধাভোগ
স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে আসছে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ভারতের লক্ষ্য ছিল এমন এক বাংলাদেশ গড়ে তোলা, যা তাদের আঞ্চলিক স্বার্থের পরিপূরক হয়। তবে এর অনিচ্ছাকৃত ফলাফল হিসেবে, বারবার জামায়াতে ইসলামীও রাজনৈতিক মুনাফা লুটেছে।
২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বিএনপি-জামায়াত জোট (BNP-Jamaat Alliance) ক্ষমতায় এলে, ভারত সরাসরি বিরোধিতায় না গিয়ে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার কৌশল নেয়। এতে করে জামায়াত আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজেদের কিছুটা সময়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়।
এরপর ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে ভারত প্রকাশ্যে শেখ হাসিনার (Sheikh Hasina) সরকারকে সমর্থন দেয়। বিএনপি-জামায়াতের নির্বাচন বর্জনের ফলে দেশে গণতান্ত্রিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়, যা জামায়াত নিজেরা “জাতীয় সার্বভৌমত্বের রক্ষক” হিসাবে পরিচিত করার প্রচারে কাজে লাগায়। যদিও অতীতে জামায়াতের ভারতবিরোধী রাজনীতি সহিংসতার ইতিহাস বহন করে, তথাপি ভারতের একপাক্ষিক সমর্থন জামায়াতকে স্বল্প সময়ের জন্য ‘দেশপ্রেমিক শক্তি’ হিসেবে প্রচারের সুযোগ দেয়।
২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে যখন ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক মধুর সময় পার করছিল, তখন দেশের তরুণ সমাজের একাংশ ভারতবিরোধী মনোভাব পোষণ করতে শুরু করে। জামায়াত এই আবেগকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের অতীতের অপরাধের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে। তবে, আদর্শিকভাবে এটি ছিল এক ভণ্ডামিপূর্ণ অবস্থান।
মাহফুজ আলমের অনমনীয় অবস্থান
এই প্রচলিত ন্যারেটিভগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মাহফুজ আলম একটি স্পষ্ট ও অনমনীয় বার্তা দিয়েছেন। তিনি একদিকে ভারতের আধিপত্যবাদী নীতির কঠোর সমালোচনা করেছেন, অপরদিকে জামায়াতে ইসলামীকে তাদের অতীত যুদ্ধাপরাধের জন্য ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
এর ফলে মাহফুজ আলম এমন এক অবস্থানে পৌঁছেছেন, যেখানে তিনি ভারতীয় প্রভাব এবং জামায়াতের সুবিধাবাদী রাজনীতির উভয় পথকেই রুদ্ধ করেছেন। ভারতের কাছে তিনি হয়ে উঠেছেন একজন অস্বস্তিকর সমালোচক, আর জামায়াতের দৃষ্টিতে তিনি বড় বাধা। কারণ, মাহফুজ আলম কোনো আপস করেননি যুদ্ধাপরাধের প্রশ্নে — এমনকি যখন তা ভারতবিরোধী আবেগের স্রোতের সঙ্গেও মিশে গেছে।
মাহফুজ আলমের উদাহরণ আমাদের দেখায়, কিভাবে একজন রাজনৈতিক নেতা প্রচলিত দ্বিচারিতার ঊর্ধ্বে উঠে নিরপেক্ষ ও ন্যায়সঙ্গত অবস্থান নিতে পারেন। ভারতের ‘গণতন্ত্র রক্ষার’ প্রচার এবং জামায়াতের ‘ভারতবিরোধী জাতীয়তাবাদের’ প্রচেষ্টা—দু’টিই আজ তার সততার সামনে প্রশ্নবিদ্ধ।
এই প্রসঙ্গে মাহফুজ আলম শুধু একজন রাজনৈতিক চরিত্র নন; তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক নীতিশক্তির এক প্রতিচ্ছবি, যিনি বলে দিয়েছেন— সার্বভৌমত্বের পক্ষে অবস্থান নেওয়া মানেই কোনো পক্ষের সুবিধাবাদে মাথা নত করা নয়।