‘মব’ নির্ভর রাজনীতির পথে হাঁটছে এনসিপি, বিতর্কে দলীয় নেতাদের ভূমিকা

পটিয়ায় এক ছাত্রলীগ নেতাকে নিয়ে পুলিশের সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) (National Citizens’ Party) ও তাদের মিত্র সংগঠন ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ নতুন করে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে, এনসিপি কি মব বা ‘বিক্ষুব্ধ জনতা’র কাঁধে চড়ে রাজনীতি করতে চাইছে?

গত মঙ্গলবার পটিয়া থানায় ছাত্রলীগের এক নেতাকে হস্তান্তর করলেও পুলিশ মামলা না থাকায় গ্রেপ্তার করতে অস্বীকৃতি জানায়। এ নিয়ে বাগ্‌বিতণ্ডা চলাকালে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের ধাক্কাধাক্কি হয়। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, যখন এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব আরিফ সোহেল তার ব্যক্তিগত ফেসবুকে লিখেন, ‘পটিয়া থানা মাটির সঙ্গে মিশায়া দিতে হবে!’

এই পোস্ট ঘিরে সামাজিক মাধ্যমে উত্তেজনা ছড়ালে, পরদিন (২ জুলাই) সকালে ওসি আবু জাহেদ মো. নাজমুন নূরের অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। রাতেই ওসি প্রত্যাহার হওয়ার খবর আসে।

এটা প্রথম নয়—এর আগেও কয়েকবার এমন মব ধরনের তৎপরতায় জড়িয়েছে এনসিপি ও তাদের ঘনিষ্ঠ ছাত্র সংগঠন। ২৯ মে রংপুরে জি এম কাদের (GM Quader)-এর বাড়িতে হামলার ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান নিজেই। যদিও অভিযুক্তরা পাল্টা অভিযোগ করে জানান, তারাই নাকি আগে হামলার শিকার হয়েছিলেন।

এর আগে ১৯ মে ঢাকার ধানমন্ডিতে ‘হাক্কানী পাবলিশার্স’-এর সামনে গোলাম মোস্তফার বাসায় বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। ওই ঘটনায় স্লোগান দিতে দেখা যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী পরিচয়ধারী কয়েকজনকে। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছালে তারা মোস্তফাকে ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ বলে গ্রেপ্তারের দাবি জানায়। কিন্তু পুলিশ মামলা না থাকায় গ্রেপ্তার না করায় উত্তেজনা বাড়ে। পরে বাগ্‌বিতণ্ডা ও উত্তেজনার মাঝে তিনজনকে আটক করে পুলিশ। পরে এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদের হস্তক্ষেপে মুচলেকা দিয়ে তারা মুক্তি পায়। তবে এর জেরে দল তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলেও, তিনি ভুল স্বীকার করায় তা প্রত্যাহার করা হয়।

বস্তুত, এসব ঘটনায় এনসিপির ‘মব’ কৌশল নিয়ে প্রশ্ন বাড়ছে। কিছুদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম নিজেই ‘মব’ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সঠিক নেতৃত্ব ও কর্মসূচির অভাবে এই জনগোষ্ঠীকে অনেকেই নিজেদের এজেন্ডায় ব্যবহার করেছে।’ তিনি আরও বলেন, এটাই তাদের সীমাবদ্ধতা।

এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, “১৫ বছর ধরে সমাজে নির্যাতিত মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ জন্মেছে, তার রূপ মবের মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। এই ক্ষোভ এখনও প্রশমিত হয়নি।”

তবে এনসিপির অন্য নেতা মুশফিক উস সালেহীন দলীয়ভাবে মব রাজনীতির অভিযোগ অস্বীকার করেন। তার ভাষায়, এনসিপি কখনোই কর্মসূচি গোপনে করে না, সবসময় নিজেদের ব্যানারে আন্দোলন করে। ফলে, ‘মব’ আড়ালে কোনো রাজনীতি তারা করে না বলেই দাবি করেন তিনি।

এই বিতর্কে সরকারি মহলেও মতবিরোধ রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমও বলেন, “আপনারা যাকে মব বলছেন, আমি বলি এটি চাপ—১৫ বছর নিপীড়নের পর মানুষ ক্ষোভ দেখাচ্ছে।”

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ (Mohiuddin Ahmed) বিষয়টিকে দ্বিমুখী বলেই দেখছেন। তার ভাষায়, “আমরা আইনের শাসনের কথা বলি, আবার নিজের হাতে আইন তুলে নেই।”

অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ (Sabbir Ahmed) মনে করেন, এই মব রাজনীতির পেছনে সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে। তিনি বলেন, “মবের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের ওপরে আধিপত্য তৈরি সহজ হয়। মানুষ ভয় পায়। এটা ভয় ধরে রাখার কৌশল। আর এর পেছনে সরকারের ইন্ধনও থাকতে পারে।”

সর্বশেষ পরিস্থিতি স্পষ্ট করে দিচ্ছে, এনসিপি এখন রাজনৈতিক সমীকরণে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করতে গিয়ে ‘মব’কে আদর্শিক কৌশল না হলেও কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

তথ্য সূত্র : বিবিসি বাংলা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *