‘জুলাই ঘোষণা’ নিয়ে বিতর্ক ও দরকষাকষি: সংবিধানের প্রস্তাবনা নাকি সংবিধানের তফসিলে থাকবে?

২০২৪ সালের জুলাই মাসে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানকে ঘিরে আলোচিত ‘জুলাই ঘোষণা’ এখন রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে। সরকার পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের (Dr. Wahiduddin Mahmud) নেতৃত্বে একটি কমিটি এর খসড়া তৈরি করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠিয়েছে। এতে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের বড় বড় রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের উল্লেখ রয়েছে—১৯৪৭ থেকে শুরু করে ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, এমনকি ২০০৯ সালের বিডিআর হত্যাকাণ্ড ও ২০১৩ সালের হেফাজতের আন্দোলনও জায়গা পেয়েছে।

তবে খসড়ায় ব্যবহৃত কিছু শব্দ এবং কাঠামো নিয়ে আপত্তি তুলেছে বিএনপি সহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। বিশেষ করে, এই ঘোষণাপত্র সংবিধানের প্রস্তাবনায় যুক্ত করা হবে কি না, সেটিই বড় বিতর্ক। বিএনপির মতে, এটি প্রস্তাবনায় নয়, বরং সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে যুক্ত করা উচিত। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ (Salahuddin Ahmed) জানান, তারা এই আন্দোলনের গুরুত্ব ও মর্যাদা স্বীকার করলেও সংবিধানগত স্বীকৃতির জন্য যুক্তিযুক্ত ও সংবেদনশীল পন্থা চাইছে।

সালাহউদ্দিন বলেন, “আমরা চাই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, তবে তা এমনভাবে হোক যেন ভবিষ্যতে এর গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ না হয়।” তিনি আরও জানান, সরকারের উপদেষ্টা সম্প্রতি ঘোষণাপত্রের একটি খসড়া বিএনপি মহাসচিবের কাছে হস্তান্তর করেছেন, যেখানে তাদের কিছু পুরনো মতামতের প্রতিফলন রয়েছে। তিনি বলেন, সংবিধান সাহিত্য নয়, আইন। একাত্তরের ১০ এপ্রিল ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রই সংবিধানের মূল অংশে ছিল না। পঞ্চদশ সংশোধনীতে সপ্তম তফসিলে যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু তা সাংবিধানিক নয়। ঘোষণাপত্রের রাজনৈতিক মূল্য রয়েছে। বিএনপি চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে মর্যাদা ও গুরুত্ব ধারণ করে। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে চায়।

তিনি আরও বলেন, বিএনপি এর আগে গত ১২ ফেব্রুয়ারি একটি খসড়া সরকারকে দিয়েছিল। এরপর আর অগ্রগতি ছিল না। এবারের খসড়ায় বিএনপির আগে দেওয়া মতামতের কিছু প্রতিফলন রয়েছে। গত বুধবার রাতে সরকারকে এবারের খসড়ায় মতামত জানানো হয়েছে।

জুলাই ঘোষণার মাধ্যমে অভ্যুত্থানের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দাবি করছে এনসিপি। এ প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন বলেছেন, ‘রাজনৈতিক ঐকমত্য হলে ক্রান্তিকালীন বিধান-সংক্রান্ত সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে যুক্ত করে জুলাই অভ্যুত্থানকে স্বীকৃতি দেওয়া যেতে পারে। চতুর্থ তফসিলে রাখা যেতে পারে, সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে।’

মূল সংবিধানে জুলাই ঘোষণাকে অর্ন্তর্ভূক্ত করতে বিএনপির আপত্তি কেন প্রশ্নে সালাহউদ্দিন বলেছেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানকে রাখলে, প্রশ্ন আসবে পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর বিপ্লব, নব্বইয়ের অভ্যুত্থান- কোথায় রাখা হবে?।’

সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর বৈধতার মামলায় পঞ্চম, ষষ্ঠ এবং সপ্তম তফসিলে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। তাই, অভ্যুত্থান-সংক্রান্ত জুলাই ঘোষণা চতুর্থ তফসিলে একটি প্যারায় রেখে, স্বীকৃতি দেওয়া যৌক্তিক হবে। আরেকটি প্যারায় বর্তমান সরকারের স্বীকৃতি দেওয়া যেতে পারে, রাজনৈতিক ঐকমত্য হলে।

অন্যদিকে আখতার হোসেন (Akhtar Hossain), জাতীয় রাজনৈতিক দল এনসিপি’র সদস্য সচিব হিসেবে দাবি করেন, “জুলাই ঘোষণাকে প্রস্তাবনায় না রাখলে এর সাংবিধানিক ও নৈতিক গুরুত্ব হারাবে। এটি শুধু একটি ঘোষণা নয়, বরং ভবিষ্যতের রাষ্ট্র পরিচালনার দিকনির্দেশনা।”

বিতর্কের আরেকটি দিক তুলে ধরেন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরীফ ওসমান বিন হাদি (Sharif Osman Bin Hadi)। তিনি বলেন, “সরকার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলছে ভালো কথা, কিন্তু জনগণকেও এর স্টেকহোল্ডার হিসেবে দেখতে হবে। তাদের মতামতও জরুরি।” তিনি আরও হুঁশিয়ার করেন, “৩১ জুলাইয়ের মধ্যে সরকার যদি ঘোষণা না দেয়, তাহলে ৩ আগস্ট আমরা সচিবালয় ঘেরাও করবো।”

শরীফ ওসমান তফসিল যুক্ত করার বিরোধিতা করে বলেন, “তফসিলে জুড়ে দেওয়া হলে যেকোনো সরকার সেটি বাদ দিতে পারে। কিন্তু প্রস্তাবনায় এলে সেটি হয়ে ওঠে অবিচ্ছেদ্য—রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির মূল স্তম্ভ।”

সরকারের দিক থেকে বিষয়টি নিয়ে সাবধানী আশাবাদ প্রকাশ করেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন, “আমরা একটা খসড়া দিয়েছি। রাজনৈতিক দলগুলো কিছু শব্দ ও কাঠামো নিয়ে আপত্তি তুলেছে। আমাদের ধারণা ছিল এ নিয়ে ঐকমত্য থাকবে, কারণ এটি জনআকাঙ্ক্ষার বিষয়।”

তিনি আরও যোগ করেন, “এই ঘোষণা শুধু জুলাই অভ্যুত্থান নয়, বরং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও এর পরবর্তী সময়ের সাংবিধানিক বৈধতার প্রতীক। তাই একে প্রস্তাবনায় জায়গা দেওয়া উচিত। আশা করছি, ৫ আগস্টের আগেই এটি চূড়ান্ত হবে।”

উল্লেখ্য সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং তফসিল দুটি ভিন্ন অংশ যা সংবিধানের অংশ। প্রস্তাবনা হলো সংবিধানের ভূমিকা বা মুখবন্ধ, যা সংবিধানের মূল লক্ষ্য ও আদর্শ তুলে ধরে। অন্যদিকে, তফসিল হলো সংবিধানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন বা বিস্তারিত বিবরণ। সংক্ষেপে বলা যায়, প্রস্তাবনা এবং তফসিল উভয়ই সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, তবে তাদের ভূমিকা ও প্রকৃতি ভিন্ন। প্রস্তাবনা হলো সংবিধানের মূল ভিত্তি এবং উদ্দেশ্য, আর তফসিল হলো সেই উদ্দেশ্যের বাস্তবায়ন ও বিস্তারিত বিবরণ। সব মিলিয়ে জুলাই ঘোষণাকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে তৈরি হয়েছে এক নতুন উত্তাপ। এটি কেবল অতীতের একটি ঘটনাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়ার প্রশ্ন নয়, বরং নতুন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কাঠামো ও সংবিধানিক দিকনির্দেশনার প্রশ্নেও পরিণত হয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *