সংবিধান ও রাষ্ট্র কাঠামোর ২০টি মৌলিক সংস্কার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে হওয়া ঐকমত্যের সংলাপে বেশ কিছু প্রস্তাবে ভিন্নমত তুলে ধরে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে বিএনপি (BNP)। দলটি ৪টি সিদ্ধান্তে সরাসরি রাজি হয়নি এবং ৩টিতে ‘নোট অব ডিসেন্ট’সহ ঐকমত্য জানিয়েছে। অন্যদিকে, সংলাপে অংশ নেওয়া অন্যান্য দল যেমন জামায়াতে ইসলামী (Jamaat-e-Islami), এনসিপি (NCP), গণঅধিকার পরিষদ, ইসলামী আন্দোলনসহ একাধিক দল নিজেদের মতবিরোধ ও আপত্তি তুলে ধরেছে। সংলাপে মতবিরোধ থাকলেও অন্তত ১১টি মৌলিক সিদ্ধান্তে সব রাজনৈতিক দল এক কণ্ঠে সমর্থন জানিয়েছে। এসব প্রস্তাবকে ‘জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তি’ বলে আখ্যা দিয়েছে বিএনপি (BNP)। বিএনপি বলছে, রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ রূপান্তরের জন্য এই প্রস্তাবগুলোই হবে মূল ভিত্তি।
এই ঐকমত্য, যেখানে মতভেদ নেই—তা দেশে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অবিশ্বাস ও বিভক্তির প্রেক্ষাপটে এক আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
যেসব বিষয়ে সর্বদলীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে
- **এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকবেন
বিএনপি এই প্রস্তাব সবচেয়ে আগে তোলে এবং এতে জামায়াত, এনসিপি, বাম ও ইসলামী দলসহ সবাই একমত হয়। রাজনৈতিক শক্তির রূপান্তরে এটি ‘গেম চেঞ্জার’ হিসেবে বিবেচিত। - স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন:
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্বাহী হস্তক্ষেপমুক্ত করতে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছে সবাই। বিএনপির মতে, এটি বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান ঘটাবে। - জরুরি অবস্থা ঘোষণায় বিরোধী দলের সম্পৃক্ততা:
সকল দল একমত হয়েছে যে, রাষ্ট্রপতি এককভাবে নয়, বিরোধী দলীয় নেতার পরামর্শ নিয়েই জরুরি অবস্থা জারি করবেন। বিএনপি এটিকে ‘গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রক্ষমতা’ প্রতিষ্ঠার চাবিকাঠি বলে মনে করে। - মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ:
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য ও কর্মসংস্থানের অধিকারকে মৌলিক অধিকারের আওতায় আনতে সংবিধান সংশোধনের ওপর একমত দলগুলো। - নির্বাচন কমিশন গঠনে সাংবিধানিক কমিটি:
সব রাজনৈতিক দলই নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে সাংবিধানিক কমিটি গঠনকে সমর্থন করেছে। বিএনপি বলছে, “গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথে এটি প্রথম ধাপ।” - সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে সাংবিধানিক কমিটি:
সীমানা নির্ধারণ নিয়ে অতীতের বিতর্ক এড়াতে সাংবিধানিক পদ্ধতিতে নিরপেক্ষভাবে এটি নির্ধারণে সম্মত হয়েছে দলগুলো। - গণভোটে চারটি গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদে সংশোধন:
সংবিধানের ৮, ৪৮, ৫৬ ও ৫৮ (ক) অনুচ্ছেদ সংশোধনে জাতীয় গণভোটের প্রস্তাবে সব দলের সম্মতি মিলেছে। এই অংশটি নিয়ে কোনো ভিন্নমত আসেনি। - রাষ্ট্রপতির ক্ষমার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণয়ন:
রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদানের বিধানকে নিয়ন্ত্রণে এনে একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায় আনতে আইন প্রণয়নের সিদ্ধান্তেও সর্বসম্মতি হয়েছে। - বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ:
প্রত্যেক বিভাগে হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপন এবং উপজেলা পর্যায়ে আদালত গঠনের সিদ্ধান্তে কোনো দল আপত্তি করেনি। বিচারপ্রাপ্তির অধিকারকে নাগরিকের নিকটবর্তী করতে এটি গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছে বিএনপি। - গোপন ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন:
সংসদের সদস্যদের গোপন ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রস্তাব সবাই গ্রহণ করেছে। শুধু ইসলামী আন্দোলন সরাসরি ভোটের পক্ষে থাকলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মতেই একমত হয় তারা। - একাধিক পদে প্রধানমন্ত্রীর নিষেধাজ্ঞা নয়, দলীয় প্রধান হিসেবে নয়:
যদিও মূল বিরোধ ছিল প্রধানমন্ত্রীর একাধিক দায়িত্বে থাকা নিয়ে, তবে দলের নেতৃত্ব ও সংসদ নেতা হিসেবে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যায় অনেক দলই সম্মত হয়—তবে তা সাংবিধানিকভাবে সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণের প্রস্তাবে।
বিএনপির বার্তা: এই ঐকমত্যই ভবিষ্যৎ ভিত্তি
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, “এই ১১ দফায় দেশের ভবিষ্যৎ সংবিধান সংস্কারের ভিত্তি তৈরি হয়েছে। আমরা চাই, বিতর্কিত প্রস্তাব বাদ দিয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত দ্রুত আইনি রূপ পাক।”
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজও এই অংশটিকে সংলাপের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখছেন। তার ভাষায়, “মতভেদ থাকতেই পারে, কিন্তু এই ১১ দফায় মতৈক্য প্রমাণ করে, রাজনৈতিক সংস্কারের দরজা খোলা আছে।”
বিএনপি: যেখানে আপত্তি, সেখানে ক্ষমতায় গেলে মূল্যায়ন
বিএনপি জানিয়েছে, তারা যে চারটি প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছে—সেগুলো সই করলেও ভবিষ্যৎ সরকারে থাকলে বাস্তবায়ন করবে না। তবে যেসব প্রস্তাবে দলীয় ভিন্নমত সহ সম্মতি রয়েছে, সেগুলো নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে।
তবে সর্বসম্মত ১১ প্রস্তাবকে তারা নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে।
সংস্কারের মূল প্রস্তাবে বিএনপির আপত্তি
বিএনপি যে চারটি সংস্কার প্রস্তাবে সরাসরি রাজি হয়নি, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে—
– পিআর (ভোটের অনুপাতে প্রতিনিধি) পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন
– প্রধানমন্ত্রী একাধিক পদে থাকতে না পারা
– দুদক, পিএসসি, সিএজি এবং ন্যায়পাল নিয়োগে সাংবিধানিক কমিটি গঠন
– র্যাংক চয়েজ ভোটে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন
এছাড়া, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে এমপিদের স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার প্রস্তাবে বিএনপি শর্তসাপেক্ষ সম্মতি দিয়েছে—আস্থা ভোট, জাতীয় নিরাপত্তা ও সংবিধান সংশোধন বিষয়ে দলীয় অবস্থানই কার্যকর থাকবে। তারা এ অবস্থানকে ভবিষ্যৎ নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেছে।
বিচারপতি ও রাষ্ট্রপতির নিয়োগ প্রশ্নে দ্বিধা
প্রধান বিচারপতি নিয়োগে কমিশনের প্রস্তাব ছিল, আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারক নিয়োগ পাবেন। বিএনপি চায়, রাষ্ট্রপতি যেন জ্যেষ্ঠতম দুই বিচারকের একজনকে বেছে নিতে পারেন। রাষ্ট্রপতির একচ্ছত্র ক্ষমতায় ১২টি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের প্রস্তাবে বিএনপি ও অন্যান্য দলও একমত নয়।
তবে মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন, প্রেস কাউন্সিল ও আইন কমিশনের নিয়োগ রাষ্ট্রপতি করতে পারবেন—এই প্রস্তাবে বিএনপি একমত। তবে বিটিআরসি, ইউজিসি ও এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের বিষয়ে তারা নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে।
সংস্কারের মূল প্রস্তাবে জামায়াত’র যত আপত্তি
জাতীয় সংলাপের সংস্কার প্রস্তাবগুলোর মধ্যে ১৬টিতে একমত হলেও নারীদের সরাসরি নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার বাধ্যবাধকতার প্রস্তাবে সায় দেয়নি জামায়াত । কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, রাজনৈতিক দলগুলোকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে কমপক্ষে ৭ শতাংশ আসনে নারী প্রার্থী মনোনয়ন দিতে আহ্বান জানানো হবে, এবং ভবিষ্যতে তা বাড়িয়ে ১২ শতাংশে উন্নীত করার পর সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে বাধ্যবাধকতা তৈরি করা হবে।
তবে জামায়াত জানায়, তারা এই পদ্ধতির সঙ্গে একমত নয়। দলটির অবস্থান, নারী প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে সংসদে নারী আসন ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০ করা যেতে পারে, কিন্তু এসব আসন সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নয়—বরং পিআর (Proportional Representation) পদ্ধতিতে বণ্টন করতে হবে।
সংবিধান সংশোধন, প্রধানমন্ত্রী ও সাংবিধানিক নিয়োগ নিয়ে আপত্তিসহ সমর্থন
জামায়াত আরও তিনটি বিষয়ে আপত্তিসহ (নোট অব ডিসেন্ট) একমত হয়েছে।
প্রথমত, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে এমপিদের স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার যে প্রস্তাব এসেছে, তাতে জামায়াত বলেছে—আস্থা ভোট বা সংবিধান সংশোধনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দলীয় অবস্থানের বাইরে গেলে সংসদ সদস্যদের আসন বাতিল হবে।
দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদ গ্রহণ না করার সিদ্ধান্তে দলটি নীতিগতভাবে একমত হলেও ব্যাখ্যার জায়গায় আপত্তি রেখেছে। কমিশনের প্রস্তাব ছিল, প্রধানমন্ত্রী দলীয় প্রধান এবং সংসদ নেতার দায়িত্ব একসঙ্গে পালন করতে পারবেন না।
জামায়াত এর জবাবে বলেছে, প্রধানমন্ত্রী দলীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না, কিন্তু সংসদ নেতা হিসেবে থাকতে পারবেন—এই সীমিত রূপেই তারা একমত।
রাষ্ট্রপতির নিয়োগ ক্ষমতা প্রসঙ্গে জামায়াতের অবস্থান
কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, কিছু সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে রাষ্ট্রপতির সরাসরি নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হবে। জামায়াত এই প্রস্তাবে আংশিকভাবে একমত হয়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে আপত্তি জানিয়েছে। দলটি মনে করে, এসব নিয়োগ যদি একতরফাভাবে রাষ্ট্রপতির হাতে দেওয়া হয়, তবে ক্ষমতার ভারসাম্য বিঘ্নিত হতে পারে।
রাজনৈতিকভাবে সাংস্কৃতিক বিরোধের প্রতিফলন
জামায়াতের অবস্থান স্পষ্টতই সামাজিক-ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। নারী প্রতিনিধিত্ব প্রসঙ্গে তাদের আপত্তি মূলত ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে উৎসারিত, যা তাদের রাজনৈতিক কৌশল ও নির্বাচনী কৌশলের মধ্যেও প্রতিফলিত।
এছাড়া, ৭০ অনুচ্ছেদ ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব বিভাজন বিষয়ে জামায়াতের মতামত সংসদীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখার পক্ষে জোরালো অবস্থান বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
সংস্কারের মূল প্রস্তাবে এনসিপি’র যত আপত্তি
কমিশনের ১৮ সিদ্ধান্তে একমত এনসিপি। দলটির নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কারে। তারা জানিয়েছে, এমপিরা আস্থা ভোট দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে দিতে পারবেন না। ৭ শতাংশ আসনে নারীদের মনোনয়নের সিদ্ধান্তেও আপত্তি জানিয়েছে এনসিপি। দলটি প্রস্তাব করেছে, অন্তত ১৫ শতাংশ আসনে নারীদের মনোনয়ন দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকতে হবে।
সাম্যবাদী ও ইসলামপন্থীদের নিজস্ব মত
সংলাপে সবচেয়ে বেশি দ্বিমত দেখা গেছে পিআর পদ্ধতি, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা খর্ব ও সংবিধান সংশোধনে উচ্চকক্ষের ভূমিকা নিয়ে। সিপিবি, বাসদ, বাংলাদেশ জাসদ সংবিধানের মূলনীতিতে ‘আল্লাহর ওপর আস্থা’ যুক্ত করার বিরোধিতা করলেও বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ ১২ দল এ বিষয়ে ঐকমত্য প্রকাশ করেছে।