চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ৪ আগস্ট বন্দরনগরী চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা অসহযোগ আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছিল। ওই দিন আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলো সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নামলেও পিছু হটতে বাধ্য হয়।
আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরল ঐক্য গড়ে ওঠে সেদিন। ছাত্রদের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করে সেনাসদস্যরা সেদিন ছাত্রদের রক্ষায় ঢাল হয়ে থাকেন। এমনকি প্রকাশ্যে ছাত্রদের পক্ষে অবস্থান নেন তারা।
ওই দিন নগরীর নিউ মার্কেট, আমতল, এনায়েত বাজার, লাভলেইন, ফলমন্ডি, বিআরটিসি, লালখান বাজার, টাইগারপাস, মেহেদীবাগ, দামপাড়া, জিইসি মোড়, আন্দরকিল্লা এলাকাসহ পুরো শহর ছিল রণক্ষেত্র। ৪ আগস্ট রোববার ভোর থেকে শিক্ষার্থীরা জনতাকে সঙ্গে নিয়ে ছোটপুল ও নিউ মার্কেট এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলন কর্মসূচির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ পাল্টা অবস্থান কর্মসূচি দেয়। সকাল ১০টার দিকে পুলিশ টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করলে ছাত্ররা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তবে ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে মুহূর্তেই ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষ শুরু হয়।
পুলিশ ও আওয়ামী ক্যাডাররা একসঙ্গে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা ও গুলি করে। যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের একটি গ্রুপ আ জ ম নাছিরের নির্দেশে মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল এবং হেলাল আকবর বাবরের নেতৃত্বে শহীদ মিনারের দিক থেকে রাইফেল ক্লাবের সামনে আসে। তারা ছাত্রদের ওপর গুলি চালাতে চালাতে আমতল মোড়ে আসে। তারা মুহুর্মুহু ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় এবং বহু শিক্ষার্থীকে মারধর করে তারা। ওই সময় কোনো পুলিশ সদস্য সেখানে ছিল না। বলা চলে, ছাত্রদের ওপর হামলা করতে আওয়ামী লীগকে উসকে দিয়ে সরে পড়ে পুলিশ।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলন দমাতে অস্ত্রসহ মাঠে নামে আওয়ামী লীগ। ইসলামিয়া কলেজ ও সিটি কলেজ থেকে ছাত্রলীগ এসে নিউ মার্কেটে অবস্থান নেয়। সেদিন বিকাল ৪টা পর্যন্ত থেমে থেমে নিউ মার্কেটসংলগ্ন ছোটপুল এলাকায় ছাত্র-জনতার সঙ্গে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে।
যুবলীগ নেতা শীর্ষ সন্ত্রাসী হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর, ছাত্রলীগের নুরুল আজিম রনি ও তাদের বাহিনীর সন্ত্রাসীরা ছাত্রদের লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো গুলি ছোড়ে। এ সংঘর্ষ আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।
ছোটপুল থেকে এনায়েত বাজারে (জুবিলী রোড) শত শত ছাত্র-জনতা অবস্থান নেন। তাদের হাতে ছিল শুধু লাঠি। সংঘর্ষে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধসহ একাধিক সাংবাদিক, পথচারী, সাধারণ মানুষ আহত হন।
পালাক্রমে যুবলীগ সন্ত্রাসীদের আক্রমণের শিকার হয়ে অনেকে আশপাশের ভবনগুলোর ছাদে আশ্রয় নেন। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীরা তাদের ঘেরাও করে আক্রমণ করতে থাকে। তবে বিএনপি-জামায়াত ও শিবিরের কর্মীরা ছাত্রদের সেখান থেকে নিরাপদে সরিয়ে আনেন।
সন্ত্রাসীদের হাতে সেদিন বন্দুক, পিস্তল, একে-৪৭ অ্যাসল্ট রাইফেলসহ ভারী বিদেশি অস্ত্র দেখা যায়। এসব ছবি বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে। বিকালে সেনাবাহিনী লালখান বাজার ও নিউ মার্কেটে শিক্ষার্থীদের সঙ্গেই ছিল তাদের একাধিক বাঙ্কার নিয়ে।
৪ আগস্ট আহত শিক্ষার্থী মো. মারুফ জানান, সেদিন আমাদের গুলি করছিল সন্ত্রাসীরা। তখন আমরা অনেক শিক্ষার্থী হকার্স মার্কেটের গলিতে আশ্রয় নেই। তারা সেখানে এসেও আমাদের পেটাতে থাকে। তাদের হাতে স্টিলের কিছু ছিল। এতে আমার চোখে মারাত্মক আঘাত লাগে। ওই আঘাতে আমি এক চোখের দৃষ্টি হারিয়েছি।
আন্দোলনকারীরা জানান, সেদিন বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের নিউ মার্কেট থেকে ধাওয়া দিলে ছত্রভঙ্গ হয়ে জুবিলী রোড ও কাজীর দেউড়ি এলাকায় আশ্রয় নেন।
একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা ওয়াসা মোড়ে জড়ো হলে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তিন দিক অর্থাৎ কাজীর দেউড়ি, লালখান বাজার ও দামপাড়ার আশপাশের গলি থেকে তাদের ঘেরাও করে হামলা করে।
৪ আগস্ট রাজপথে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। সেদিন শিক্ষার্থীদের একটি মিছিল নগরীর জামালখান মোড় থেকে কাজীর দেউড়ি মোড়ের দিকে যাওয়ার পথে হামলা করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ওই হামলার নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের জামালখান ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন।
সেদিন তার পাশে একজনকে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে দেখা যায়। তার মাথায় হেলমেট ছিল। একই মিছিলে আরেকজনকে কোমরে থাকা অস্ত্র বের করতে দেখা যায়। ওই দল থেকে মুহুর্মুহু গুলি করা হয় শিক্ষার্থীদের ওপর। ওই দিন গুলিবিদ্ধ হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৭৫ জন ভর্তি হন। এছাড়া জেলার পটিয়ায় গুলিবিদ্ধ হন পাঁচজন।