“ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে, পরবর্তী সরকারের নির্বাচিত বা নিযুক্ত কোনো পদে আমি থাকব না” – ড. মুহাম্মদ ইউনূস

যুক্তরাষ্ট্রের ইউটাহভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডেসারাট নিউজ (Deseret News)-এ একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস (Dr. Muhammad Yunus)। সেখানে তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর তিনি রাষ্ট্রের কোনো পদেই থাকবেন না। তার ভাষায়, “আমার দায়িত্ব কেবল একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন করা—আমি স্পষ্ট করেছি : জাতীয় নির্বাচন আগামী ফেব্রুয়ারিতে হবে। এরপর যে সরকার আসবে সেখানে নির্বাচিত বা নিযুক্ত করা কোনো পদে আমি থাকব না।” ”

ইউনূসের নিবন্ধে উঠে এসেছে গত বছরের গণঅভ্যুত্থানের কথা, যেটি দীর্ঘদিনের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটায়। তিনি লিখেছেন, “এক বছর আগে এই মাসেই হাজারো ছাত্র-তরুণের নেতৃত্বে, সর্বস্তরের মানুষের সমর্থনে, বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায় শেষ হয়েছিল। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে রক্ত ঝরলেও অবশেষে ৫ আগস্ট স্বৈরশাসক দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়।”

এই পরিস্থিতিতেই ছাত্রনেতাদের আহ্বানে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দিতে রাজি হন। ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট তিনি সুশীল সমাজের নেতাদের নিয়ে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী, তরুণ প্রজন্মের আত্মত্যাগ উপেক্ষা করার কোনো উপায় তার ছিল না।

ইউনূস নিবন্ধে ‘জেনারেশন জেড’ বিপ্লবের কথাও উল্লেখ করেছেন, যা সরকারি চাকরিতে ন্যায্যতা আদায়ের দাবিতে শুরু হলেও দ্রুতই এক সর্বাত্মক আন্দোলনে রূপ নেয়। তিনি বলেন, “তরুণরা অপেক্ষা করেনি তাদের পালা আসার জন্য, বরং বুঝেছিল এখনই পদক্ষেপ নেওয়ার সময়।”

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশজুড়ে অব্যবস্থা দেখে তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন। পুলিশ নিষ্ক্রিয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে, অর্থনীতি ধ্বংসস্তূপে, গণতন্ত্র ভেঙে পড়া—এই চিত্র তার সামনে ছিল। তবে ধীরে ধীরে সংস্কারের পথে যাত্রা শুরু হয়। রাজনৈতিক দলগুলো নতুন উদ্যমে সংগঠিত হয়, সেনাবাহিনীও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখে।

তার মতে, সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার ছিল নিহত ও আহত আন্দোলনকারীদের পরিবারের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা এবং সাবেক সরকারের লুট হওয়া বিপুল অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (Transparency International Bangladesh)-এর তথ্য উদ্ধৃত করে তিনি জানান, গত ১৫ বছরে বছরে ১০ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার আত্মসাৎ করা হয়েছে।

বিদেশনীতি নিয়েও পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছেন ইউনূস। তিনি জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর সহযোগিতা তারা গুরুত্ব সহকারে দেখছেন। সম্প্রতি রুবিওর সঙ্গে তার “ফলপ্রসূ ও বন্ধুত্বপূর্ণ বৈঠক” হয়েছে। এছাড়া যুক্তরাজ্য, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বিশ্বব্যাংক এবং জাতিসংঘ বাংলাদেশের এই পরিবর্তনের যাত্রায় পাশে রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

সবশেষে তিনি জানিয়েছেন, নির্বাচনের পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সাংবিধানিক সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করা হচ্ছে। এর মূল লক্ষ্য হলো—বাংলাদেশ যেন আর কখনো স্বৈরাচারী শাসনে ফিরে না যায়।

তার কথায়, “যদি বাংলাদেশ এমন এক দেশে পরিণত হয় যেখানে সবাই নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারে, তবে তা হবে লাখো মানুষের সাহস, দৃঢ়তা ও কল্পনার জয়।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *