অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল (Dr. Asif Nazrul) বলেছেন, সেনাপ্রধান ও প্রধান বিচারপতির সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে গুজব ছড়িয়েছে, তা ভিত্তিহীন। সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি স্পষ্ট করে জানান, “এ ধরনের কোনো তথ্য আমার জানা নেই। কেবল দু-একটি পত্রিকায় পড়েছি, অনলাইনে গুজব দেখেছি। এসব নিয়ে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই।”
তিনি আরও বলেন, সেনাপ্রধান নিয়মিতই প্রধান উপদেষ্টা ও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেন। তাই এটিকে বিশেষ কিছু হিসেবে দেখার কারণ নেই। কেয়ারটেকার সরকার গঠনের সম্ভাবনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমি এ ধরনের কোনো তথ্য জানি না।” আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের প্রসঙ্গে আইন উপদেষ্টা পুনর্ব্যক্ত করেন যে সরকার ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, এবং নির্বাচন কমিশন সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিচ্ছে।
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রসঙ্গে তিনি স্বীকার করেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কখনো অবনতি আবার কখনো উন্নতি ঘটেছে। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে অস্থিরতা অস্বাভাবিক নয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তবে সরকারের ভেতরে সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। উপদেষ্টাদের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। নুরুল হক নুরের ওপর হামলার ঘটনায় এক উপদেষ্টা নিন্দা জানান, আরেকজন সরকারের দায় স্বীকারের কথা বলেন। এ ধরনের মন্তব্য সাধারণ মানুষকে আরও বিভ্রান্ত করছে। রাজনৈতিক দলগুলোও সরব সমালোচনায়, বিশেষ করে জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সরকারের পাশাপাশি সেনাবাহিনীকেও আক্রমণাত্মক ভাষায় সমালোচনা করছে।
চীন সফর শেষে দেশে ফিরে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সেনাপ্রধানের সাক্ষাৎ জনমনে নতুন গুঞ্জনের জন্ম দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এসব গুজব জনমনে অস্থিরতা বাড়াচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে—কি ঘটছে পর্দার আড়ালে? ফেব্রুয়ারির নির্বাচন আদৌ হবে কিনা, কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসছে কি না—এসব অনিশ্চয়তা ঘুরপাক খাচ্ছে চারপাশে।
নুরুল হক নুরের ওপর হামলার পর পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়েছে। ওই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন ড. আসিফ নজরুল। তবে তার পোস্টে এনসিপির নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখান। অন্যদিকে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা সজীব ভূঁইয়া হামলার দায় স্বীকার করার আহ্বান জানান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি, যা হাস্যরসও সৃষ্টি করেছে।
বিএনপি নেতারা মনে করছেন, এই হামলা পরিকল্পিত, যার উদ্দেশ্য নির্বাচন ব্যাহত করা। গণঅধিকার পরিষদ সরাসরি সেনা ও পুলিশকে দায়ী করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেছে। দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম অভিযোগ করেন, সেনাবাহিনী হামলাকে ‘মব ভায়োলেন্স’ আখ্যা দিয়ে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছে, যা দেশকে আরও অস্থিতিশীল করবে।
এমন প্রেক্ষাপটে সোমবার সেনাপ্রধান প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের প্রস্তুতি নিশ্চিত করার কথা জানান। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারকে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
একই দিনে রাজধানীর একটি অনুষ্ঠানে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য (Dr. Debapriya Bhattacharya) মন্তব্য করেন, “বাংলাদেশের ওপর দিয়ে এখন একটি ঝড় বয়ে যাচ্ছে।” তার মতে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি একসঙ্গে সংকটে পড়েছে। তবে জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পাওয়া বৈষম্যবিরোধী চেতনাকে টিকিয়ে রাখা এখন সময়ের বড় চ্যালেঞ্জ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হকও মনে করেন, গণঅভ্যুত্থানের পর দায়িত্বশীল আচরণ না করলে অরাজনৈতিক সরকারের পক্ষে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন পক্ষ নিজেদের স্বার্থে চাপ প্রয়োগ করছে, অথচ সরকারকে পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছে না। এর ফলেই সাধারণ মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।
সব মিলিয়ে স্পষ্ট হচ্ছে—উপদেষ্টাদের মধ্যে মতপার্থক্য, রাজনৈতিক চাপ, সেনাবাহিনীর ভূমিকা এবং ক্রমবর্ধমান গুজব—সব মিলে দেশ এক অস্থির পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। জনমনে প্রশ্ন জেগেছে, আসলে দেশ কোন পথে এগোচ্ছে।