দীর্ঘ ষোলো বছরের ভোটাধিকার বঞ্চনার পর ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের পর থেকে সাধারণ মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন ব্যালটের মাধ্যমে নিজেদের মত প্রকাশের। এর মধ্যে নতুন করে চার কোটিরও বেশি তরুণ ভোটার যুক্ত হয়েছেন। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও লুণ্ঠিত ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, সেনাবাহিনী এবং নির্বাচন কমিশন (ইসি) প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রায় সব রাজনৈতিক দলও (দু’তিনটি বাদে) অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মাঠে নেমেছে। ইতোমধ্যে ইসি ঘোষণা করেছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস (Dr. Muhammad Yunus) স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন—জাতীয় নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই ভোট হবে, আর নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র জাতির জন্য বিপজ্জনক। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, কেউ যদি নির্বাচন বিলম্বিত করতে চায়, তা অরাজকতা ডেকে আনবে। ইতোমধ্যেই জামায়াত – এনসিপি সহ বেশ কিছু দল প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পি আর) পদ্ধতির দাবি তুলে নির্বাচন বিলম্বিত করার কৌশল নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নির্বাচন যত দেরি হবে, অন্তর্বর্তী সরকার ততই দুর্বল হবে এবং বিশৃঙ্খলার সুযোগ নেবে পতিত আওয়ামী লীগ ও তাদের সমর্থক ভারত। আর বুঝে না বুঝে শুধু মাত্র নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধিতে জামায়াত, এনসিপি সহ পনের বছর ধরে হাসিনাকে হাত পাখা দিয়ে বাতাস দিয়ে যাওয়া ইসলামী আন্দোলনের মতো দলগুলো আওয়ামীলীগ আর আর ফ্যাসিস্ট সহযোগীদের সেই সুযোগই দিতে যাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বীর আহমেদ বলেছেন, বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় দ্রুত নির্বাচন। তিনি মনে করেন, জামায়াত বা এনসিপি যদি মনে করে নির্বাচন পেছালে তারা লাভবান হবে, সেটি ভুল ধারণা। অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিয়ে তৃতীয় কোনো পক্ষ ক্ষমতা দখল করলে আওয়ামী লীগ পুনরায় শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও সংকট গভীর। আওয়ামী লীগ রেখে যাওয়া ভঙ্গুর অর্থনীতি এখনো দাঁড়াতে পারেনি। ব্যবসায়ীরা নির্বাচিত সরকারের দাবি জানিয়ে সতর্ক করেছেন, বিলম্ব হলে বিনিয়োগ আরও কমে যাবে। বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেছেন, একটি গ্রহণযোগ্য সরকার ছাড়া বিনিয়োগের গতি ফেরানো সম্ভব নয়।
সেনাবাহিনীও নির্বাচনে সম্পূর্ণ সহযোগিতা দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সোমবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতে বলেন, পুরো সেনাবাহিনী সরকারের প্রতিটি কর্মসূচি সফল করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। জবাবে ড. ইউনূস জানান, জাতির কাছে তার অঙ্গীকার—একটি সুষ্ঠু, নিরাপদ ও উৎসবমুখর নির্বাচন উপহার দেওয়া।
এদিকে, বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও জামায়াত ও এনসিপি নানা শর্ত তুলে ধরেছে। তাদের মতে, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ছাড়া নির্বাচনের প্রস্তুতি ভবিষ্যতে নতুন সংকট তৈরি করবে। অন্যদিকে বিএনপি বলেছে, যে দল নির্বাচনবিরোধী অবস্থান নেবে, তারা রাজনীতির মাঠ থেকে বাদ পড়বে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অধীনে তৈরি জুলাই জাতীয় সনদ এখনো চূড়ান্ত হয়নি। ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের ওপর ঐকমত্য হলেও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। বিএনপি চায় কিছু সংস্কার অধ্যাদেশের মাধ্যমে হোক, সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হলে পরবর্তী সংসদে করা যাবে। জামায়াত গণভোটের দাবি তুলেছে, আর এনসিপি বলছে গণপরিষদ গঠন করতে হবে। নারীর প্রতিনিধিত্ব ও সংবিধানের অগ্রাধিকার নিয়ে মতভেদ এখনো গভীর। ফলে নির্বাচনের আগে এই সনদ নিয়ে সমঝোতা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার পর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সাম্প্রতিক সময়ে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের ওপর হামলা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র রাজনীতির উত্তেজনা, জাতীয় পার্টি ইস্যুতে অস্থিরতা—এসবই প্রমাণ করে নির্বাচন ঘিরে ষড়যন্ত্র থেমে নেই। পতিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও আবার মিছিলের চেষ্টা করছে, যা অস্থিতিশীলতা তৈরির অপচেষ্টা বলে মনে করছেন সচেতন মহল। নুরের ওপর হামলা ঠিক কতটা অতর্কিত আর ঠিক কতটা পূর্বপরিকল্পিত তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অনেকেই।
উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন সতর্ক করে বলেছেন, আওয়ামী লীগ ফিরে এলে আন্দোলনে অংশ নেওয়া কাউকে ছাড়বে না। তাদের কাছে আন্দোলনকারীদের সব তথ্য আছে, এবং তাদের সহনশীলতার কোনো উদাহরণ নেই। তিনি মনে করেন, এবার তারা আগের চেয়েও আক্রমণাত্মক হবে।
অর্থনীতিবিদ ড. ফাহমিদা খাতুন মনে করিয়ে দিয়েছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া বিনিয়োগ আসবে না। তাই দেশের স্বার্থেই জরুরি একটি সুষ্ঠু নির্বাচন। জনগণও দীর্ঘ অপেক্ষার পর ব্যালটের মাধ্যমে নিজেদের মত প্রকাশ করতে প্রস্তুত। তাদের প্রত্যাশা, এবার আর কোনো কাঁটা যেন ভোটের পথে বিছানো না হয়। বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন—এই তিনটি এখন জাতীয় স্বার্থের মূল স্তম্ভ। এর মধ্যে নির্বাচনই সংকট সমাধানের একমাত্র পথ।