১৯৮১ সালের ১৭ মে থেকে একটানা চার দশকেরও বেশি সময় ধরে শেখ হাসিনা (Sheikh Hasina) আওয়ামী লীগের সভাপতির পদে রয়েছেন। কিন্তু দীর্ঘ এই সময়ে তিনি কখনো প্রকাশ্যে বলেননি বা ইঙ্গিত দেননি, তার অনুপস্থিতিতে দলীয় নেতৃত্বের ভার কে নেবেন। এই অমীমাংসিত উত্তরাধিকার পরিকল্পনাই (সাকসেসন প্ল্যান) বড় দুর্বলতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল—বিশেষত গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ কার্যত ভেঙে পড়েছিল।
বর্তমানে ভারতের মাটিতে প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অবস্থান করছেন শেখ হাসিনা, যেখানে তার কার্যক্রম ও দলীয় যোগাযোগ কঠোরভাবে সীমিত। এই প্রেক্ষাপটে বয়স ও পরিস্থিতির চাপে তিনি উত্তরাধিকার প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছেন। বিবিসি বাংলা জানিয়েছে, শেখ হাসিনা তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় (Sajeeb Wazed Joy) ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল (Saima Wazed Putul)-কে নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বে আনতে যাচ্ছেন। একইসঙ্গে শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিকেও একটি ভূমিকায় আনার কথা ভাবা হচ্ছে। এমনটাই জানানো হয়েছে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে।
রাহুল-প্রিয়াঙ্কা মডেল অনুসরণ
ভারতের কংগ্রেস যেমন রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে সামনে এনে নেতৃত্ব সাজাচ্ছে, আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও শেখ হাসিনা প্রায় একই মডেল প্রয়োগ করছেন। তার ছেলে জয় মূলত দলের মুখপাত্র হয়ে বিদেশে বয়ান তৈরি ও মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলছেন, অন্যদিকে মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ দিল্লিতে মায়ের কাছাকাছি থেকে দিন-প্রতিদিনের কাজে সরাসরি সহায়তা করছেন।
সায়মা ওয়াজেদকে গত জুলাইতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক পদ থেকে অনির্দিষ্টকালের ছুটিতে পাঠানো হয়। বাংলাদেশ সরকারের আপত্তি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলার কারণে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। হু-তে ফেরার সম্ভাবনা কার্যত শেষ হয়ে যাওয়ায় তিনি এখন পূর্ণকালীন রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন। এমনকি শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের ব্যবস্থা করাও এখন তার অন্যতম কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আওয়ামী লীগের ভেতরে প্রতিক্রিয়া
দলের ভেতরে উত্তরাধিকার পরিকল্পনার প্রসঙ্গ অত্যন্ত সংবেদনশীল। একাধিক শীর্ষ নেতা বিষয়টি নিশ্চিত করলেও প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলতে চাননি। তবে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আরাফাত দাবি করেছেন, দলের ভেতরে এ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। তার মতে, দলের প্রধান লক্ষ্য এখন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, পদ-পদবীর প্রশ্ন নয়।
গান্ধী পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক
গান্ধী পরিবারের সঙ্গে শেখ হাসিনার সম্পর্ক পুরনো ও ব্যক্তিগত। সোনিয়া গান্ধী ও শেখ হাসিনার প্রায় সমবয়সী বন্ধুত্ব, আর রাহুল-প্রিয়াঙ্কার রাজনৈতিক পথচলাও তিনি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে আসছেন। ২০২৩ সালে দিল্লি সফরে তিনি রাহুল গান্ধীর সঙ্গে আলাদা করে দেখা করার জন্যও উদ্যোগী হয়েছিলেন। বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগের জন্য ‘পরিবারকেন্দ্রিক উত্তরাধিকার’ একেবারেই স্বাভাবিক সিদ্ধান্ত।
দলীয় কাঠামোয় পরিবর্তন
ভারতে অবস্থান করলেও শেখ হাসিনা কলকাতাভিত্তিক তিন নেতার ওপর ভরসা রাখছেন—সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আ.ফ.ম. বাহাউদ্দিন নাসিম ও জাহাঙ্গীর কবির নানক। তারা নিয়মিত যোগাযোগে রয়েছেন এবং সায়মা ওয়াজেদ তাদের সঙ্গে অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করছেন। অন্যদিকে জয় যুক্তরাষ্ট্র থেকে মিডিয়া ও বয়ান রাজনীতির দায়িত্ব সামলাচ্ছেন।
সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কার্যত কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। প্রায় দশ মাস ধরে তিনি শেখ হাসিনার সাক্ষাৎ পাননি। ফলে আওয়ামী লীগের দৈনন্দিন কাজকর্ম এখন মূলত শেখ পরিবারের হাতে, আরেকটি পরিবারকেন্দ্রিক কাঠামোতেই দল এগোচ্ছে।
৭৬ বছরের বেশি পুরনো এই দল আজ হয়তো ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে। তবুও নেতৃত্বের লাগাম রয়ে গেছে ‘ফার্স্ট ফ্যামিলি’র হাতেই।
তথ্য সূত্র : বিবিসি বাংলা