পুরষ্কার হিসাবে ‘রাতের ভোটের কারিগররা’ পেয়েছিল ২০০ ফ্লাটের বরাদ্দ

দুঃস্থ ও উচ্ছেদ হওয়া মানুষের জন্য নির্মিত পুনর্বাসন ফ্ল্যাট কীভাবে ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর দখলে চলে গেল, তার ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। সরকারি জমি ও অর্থে নির্মিত এসব ফ্ল্যাট গরিব ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য নির্ধারিত ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ (Awami League) সরকারের আমলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ফ্ল্যাটগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয় সিনিয়র সচিব, প্রকল্প কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের দলীয় শিক্ষক, আমলা ও রাজনৈতিকভাবে সুবিধাভোগী ব্যক্তিদের হাতে—যাদের অনেকেই আগে থেকেই একাধিক ফ্ল্যাট বা প্লটপ্রাপ্ত। মিথ্যা তথ্য দিয়ে একাধিক সুবিধা নেওয়ার ঘটনাও প্রকাশ পেয়েছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি শুধু ক্ষমতার অপব্যবহার নয়; এটি হাজারো বাস্তুচ্যুত মানুষের অধিকার হরণ ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাতের ভয়ঙ্কর উদাহরণ।

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা জমিতে বসবাসকারী ৯ হাজার ১৯০ জন ক্ষতিগ্রস্তকে পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় “সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রকল্প”-এর মাধ্যমে। সেখানে নির্মিত হয় ১২টি বহুতল ভবনে মোট ১,৩৪৪টি ফ্ল্যাট। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে ১,২২০টি আবেদন জমা পড়ে, অথচ ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয় মাত্র ৩০২ পরিবারকে—সেটিও এখনো হস্তান্তর হয়নি।

বাকি ফ্ল্যাটগুলো ভাগ হয়ে যায় নির্বাচিত আমলা, সচিব, প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও দলীয় গোষ্ঠীর হাতে। অন্তত ২৯ জন সিনিয়র সচিব ও সচিব, ১৫৮ জন সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মচারী, ১২ জন পদ্মা সেতু প্রকল্প কর্মকর্তা, ৫ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ২৭ জন বোর্ড সদস্য এবং ১৩ জন মন্ত্রীর দপ্তরের কর্মচারী ফ্ল্যাট পান।

চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো, বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার (Abdur Rouf Talukder) ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান (Anisur Rahman), যাদের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের ‘ভোট কারচুপির’ মূল কারিগর হিসেবে অভিযোগ আছে।

তদন্তে দেখা গেছে, অন্তত ৫০ জন কর্মকর্তা পূর্বে রাজউক, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ বা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ থেকে একাধিক প্লট বা ফ্ল্যাট নিয়েছেন। নতুন ফ্ল্যাট পাওয়ার সময় তারা এসব তথ্য গোপন করে মিথ্যা হলফনামা দিয়েছেন। যেমন, এক কর্মকর্তা একসঙ্গে পদ্মা ভবনে ফ্ল্যাট, পূর্বাচলে প্লট, লালমাটিয়ায় ফ্ল্যাট ও উত্তরায় প্লট নিয়েছেন।

২০১৭ সালের স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইনের ১৯(১) ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, যে উদ্দেশ্যে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তা ছাড়া অন্য কাজে ব্যবহার করা যাবে না—যদি না ভূমি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন থাকে। কিন্তু কোনো অনুমোদন ছাড়াই সেতু কর্তৃপক্ষ পুনর্বাসন প্রকল্পের জমিতে ‘সেতু কর্তৃপক্ষ আবাসন প্রকল্প’ হাতে নেয়। গৃহায়ন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা একে সরাসরি “অবৈধ ও বেআইনি” বলেছেন।

অধিগ্রহণকৃত ভূমিহীন পরিবারগুলো আজও আশ্রয়হীন। তাদের প্রতিশ্রুত ঘর চলে গেছে প্রভাবশালী মহলের হাতে। মোট ৪০ একর জমিতে নির্মিত বহুতল ভবন, আধুনিক সুবিধা ও কমিউনিটি সেন্টার আজ ভোগ করছে আমলা ও ধনী গোষ্ঠী—যেখানে থাকার কথা ছিল হাজারো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও ভূমিহীন মানুষের।

তৎকালীন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের (Obaidul Quader)-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অন্তত ১২টি বৈঠকে এসব বরাদ্দের সিদ্ধান্ত হয়। অভিযোগ রয়েছে, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে ‘রাতের ভোট’-এ ভূমিকা রাখা ব্যক্তিদের অনেকেই ‘বিশেষ কোটায়’ ফ্ল্যাট পেয়েছেন। তালিকায় আছেন তার ব্যক্তিগত সহকারী, বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সচিব, পরিকল্পনা কমিশনের সচিব, অবসরপ্রাপ্ত সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তা।

একজন উপসচিব, যিনি মিথ্যা হলফনামার তালিকায়ও আছেন, নির্লজ্জ ভঙ্গিতে বলেন—“আমার স্যার পেয়েছেন, আমি কেন পেছনে থাকবো? অফিসে থাকতে গেলে একটা ফ্ল্যাট দরকার।” এই বক্তব্য প্রমাণ করে, ফ্ল্যাট কেবল বাসস্থান নয়; এটি প্রভাব, ক্ষমতা ও মর্যাদার প্রতীক হয়ে উঠেছে।

সরকারি সম্পদের এমন বণ্টন শুধু প্রশাসনিক দুর্নীতির চিত্রই নয়, সমাজে বৈষম্যের গভীর সংকেতও দেয়। যেখানে গরিবের নামে বরাদ্দ হয় ঘর, অথচ তার চাবি চলে যায় প্রভাবশালীর হাতে। বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, এ বিষয়ে স্বচ্ছ তদন্ত ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে ভবিষ্যতের পুনর্বাসন প্রকল্পগুলো আর গরিবের জন্য নয়, বরং নতুন এক “ধনীকরণ প্রকল্পে” পরিণত হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *