২০১৮ সালের রাতের ভোট ও ২০২৪ সালের সাজানো নির্বাচনে ভূমিকা রাখা বদরুলসহ এনএসআইয়ের তিন কর্মকর্তা পলাতক, ‘র’-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ

জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স (এনএসআই)-এর তিনজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা বিদেশে পালিয়ে গেছেন। নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, তাদের মধ্যে দুজন ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (র)-এর এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন এবং এনএসআইয়ের সংবেদনশীল নথি বাইরে পাচার করেছেন। এ ঘটনায় গোয়েন্দা মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।

পালিয়ে যাওয়া কর্মকর্তারা হলেন—এনএসআইয়ের যুগ্ম পরিচালক বদরুল আহমেদ (বিদ্যুৎ), উপ-পরিচালক আমিনুল হক পলাশ এবং সহকারী পরিচালক তানভীর হোসেন খন্দকার। তারা দুবাই কনস্যুলেট, কলকাতা মিশন ও ঢাকার বিভিন্ন অবস্থান থেকে গা-ঢাকা দিয়েছেন। এর মধ্যে আমিনুল হক পলাশ বিকল্প সবুজ পাসপোর্ট ব্যবহার করে ভারত হয়ে ব্রিটিশ ভিসা সংগ্রহ করেন এবং লন্ডনে পালিয়ে যান। বাকি দুজনের অবস্থান এখনো শনাক্ত করতে পারেনি এনএসআই সদর দপ্তর।

আমিনুল হক পলাশ: ইউনূসকে হয়রানির নেপথ্যের কারিগর

সূত্রগুলো জানিয়েছে, পলাতক উপ-পরিচালক আমিনুল হক পলাশ ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস (Muhammad Yunus)-এর বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া অসংখ্য মামলার মূল পরিকল্পনাকারী। তাকে এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) টিএম জোবায়ের এই দায়িত্বে নিয়োগ দেন।

পলাশের নেতৃত্বে ড. ইউনূসকে নানা মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করা হয়—আদালত প্রাঙ্গণে লিফট বন্ধ রেখে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে বাধ্য করা, বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে কষ্ট দেওয়া, আন্তর্জাতিক সম্মানহানি ঘটানোর প্রচেষ্টা—সবই তার পরিকল্পনার অংশ ছিল। কলকাতা মিশনে দ্বিতীয় সচিব হিসেবে পোস্টিং দেওয়ার পরও তাকে দেশে তলব করা হলে তিনি ফিরে আসেননি। পরিবর্তে অবৈধ সবুজ পাসপোর্ট ব্যবহার করে লন্ডনে পালিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় চান। বর্তমানে সেখানকার বিভিন্ন টেলিভিশন টকশোতেও অংশ নিচ্ছেন তিনি।

বদরুল আহমেদ: নির্বাচনী প্রকৌশলের দায়িত্বে

এনএসআইয়ের পলাতক যুগ্ম পরিচালক বদরুল আহমেদ (Badrul Ahmed) ছিলেন ২০১৮ সালের “রাতের ভোট” এবং ২০২৪ সালের “ডামি নির্বাচন”-এর নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিত। অভিযোগ রয়েছে, তিনি এনএসআইয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক টিএম জোবায়েরের সঙ্গে মিলে বিদেশে অর্থ পাচারের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন।

ছাত্রজীবনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক থাকা বদরুল ২০১১ সালে এনএসআইতে যোগ দেন। পরবর্তীতে সহকারী পরিচালক থেকে ধাপে ধাপে উচ্চপদে উন্নীত হন। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে তিনি হাসিনা সরকারের পক্ষে “কী রোল” পালন করেন। ২০২৩ সালে দুবাই কনস্যুলেটে দ্বিতীয় সচিব হিসেবে কর্মরত থাকার সময় ২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রকৌশলে অংশ নিতে তাকে হঠাৎ ঢাকায় ডেকে আনা হয়। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর বিকল্প পাসপোর্ট ব্যবহার করে সেখান থেকে তিনি পালিয়ে যান।

তানভীর হোসেন খন্দকার: জাল সার্টিফিকেটে চাকরি

সহকারী পরিচালক তানভীর হোসেন খন্দকার (Tanvir Hossain Khondokar), র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক এম খুরশীদ হোসেনের ছেলে। অভিযোগ রয়েছে, তিনি জাল মাস্টার্স সার্টিফিকেট দিয়ে এনএসআইতে যোগ দেন। প্রশিক্ষণকালীন সময়ে শৃঙ্খলাভঙ্গ, অনুপস্থিতি, মাদক সেবনসহ নানা অপরাধে তার বিরুদ্ধে তদন্ত হয়। এমনকি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার পরও তিনি সংস্থায় বহাল ছিলেন। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে তিনিও পলাতক।

ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলার অন্ধকার অধ্যায়

শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশে ড. ইউনূস ও তার প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে মোট ১৬৮টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এর মধ্যে শ্রম আদালতে ১৬৬টি, দুদকে একটি এবং ফৌজদারি আদালতে একটি। অভিযোগপত্র তৈরি, সাক্ষী খোঁজা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিকভাবে তাকে হেয় করার পরিকল্পনা—সবকিছুতেই এনএসআই ব্যবহার করা হয়।

আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, আদালতের লিফট বন্ধ রেখে ড. ইউনূসকে হেঁটে তলায় তলায় ওঠানোসহ নানা অমানবিক আচরণের শিকার হতে হয়েছে তাকে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনও একে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার নিষ্ঠুর বহিঃপ্রকাশ বলে অভিহিত করেছেন।

এনএসআইয়ের অবস্থান

এনএসআই কর্তৃপক্ষ তিন কর্মকর্তার পালিয়ে যাওয়ার সত্যতা স্বীকার করেছে। সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে এবং আইন অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া ইতোমধ্যে তাদের কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাতিল করা হয়েছে। ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-৬কেও আমিনুল হক পলাশের বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে।

বর্তমান মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবু মোহাম্মদ সরোয়ার ফরিদের নেতৃত্বে এনএসআই দাবি করছে, সংস্থার ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে এবং স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এখন তাদের প্রধান লক্ষ্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *