দেশে সম্প্রতি ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। এডিস মশাবাহিত এই দুই রোগের উপসর্গ প্রায় কাছাকাছি হওয়ায় প্রাথমিকভাবে রোগ সনাক্তকরণে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। অনেক রোগীর ডেঙ্গুর টেস্ট নেগেটিভ আসলেও পরবর্তী পরীক্ষায় চিকুনগুনিয়া ধরা পড়ছে।
ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার উপসর্গে পার্থক্য
ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার উপসর্গ মিল থাকলেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। ডেঙ্গুতে সাধারণত শরীরে উচ্চ তাপমাত্রা, চার-পাঁচ দিন পর লালচে র্যাশ, রক্তক্ষরণ, প্লাটিলেট কমে যাওয়া এবং শক সিনড্রোমের ঝুঁকি থাকে। কোনো কোনো ক্ষত্রে চোখে ব্যথা’র উপসর্গ দেখা যায়। এছাড়া অনেক সময় লিভার, হার্ট ও কিডনিসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অন্যদিকে, চিকুনগুনিয়াতে প্রথমে জ্বর হলেও এর তীব্রতা পরে কমে আসে। তবে শরীরের জয়েন্টে তীব্র ব্যথা এবং হাত-পা ফুলে যাওয়া দেখা যায়। রোগী হাঁটা-চলা করতে বা বসা থেকে উঠতে সমস্যায় পড়েন। এ কারণে একে ‘ল্যাংড়া জ্বর’ও বলা হয়। চিকুনগুনিয়াতে রক্তক্ষরণ হয় না, প্লাটিলেট কমে না এবং মৃত্যুঝুঁকিও তুলনামূলক ভাবে কম। তবে দীর্ঘমেয়াদে জয়েন্টে ব্যথা ভোগায় রোগীকে।
ডেঙ্গুর উপসর্গ
- ডেঙ্গু জ্বরে এখন তীব্র তাপমাত্রা থাকে।
- চার-পাঁচদিন পরে শরীরে লাল লাল র্যাশ হয়। র্যাশটা বেশি হয়।
- ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী অনেক সময় শক সিনড্রোমে চলে যায়।
- রক্তের প্লাটিলেট কমে যায়। ফলে রক্তক্ষরণ হয়।
- একজন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি থাকে।
- ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর শরীরে ব্যথাও থাকে, তবে ততটা তীব্র নয়।
- অনেক সময় ‘এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু’ যেমন এই জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির লিভার, হার্ট, কিডনিসহ
- শরীরের নানা অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ফলে সেই অনুযায়ী রোগীকে চিকিৎসা দিতে হয়।
- ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা খেতে পারেন না, বমি করেন।
চিকুনগুনিয়ার উপসর্গ
- চিকুনগুনিয়াতে আক্রান্ত রোগীর প্রথমেই জ্বর হয়। কিন্তু দুই – তিন দিন পরে জ্বরের তীব্রতা খুব একটা বেশি থাকে না। পরে থেমে থেমে আবার রোগী জ্বরে আক্রান্ত হন। সেটা কখনো কখনো ১০২ ডিগ্রি থেকে ১০৪ ডিগ্রিও হয়।
- শরীরে প্রতি জয়েন্টে জয়েন্টে তীব্র ব্যথা থাকে। প্রায় সব মাসলেও এই ব্যথা থাকে। তীব্র ব্যথায় রোগী হাঁটা – চলা করতে পারে না, বসলে উঠতে পারে না এমন পরিস্থিতিও তৈরি হয়। চিকিৎসক মি. আব্দুল্লাহ জানান, এই জ্বরকে ‘ল্যাংড়া জ্বর’ ও বলা হয়।
- চিকুনগুনিয়া রোগের অন্যতম উপসর্গ জ্বরের পরে রোগীর পুরো শরীরের গিরায় গিরায় ব্যথা হয়। হাত – পা ফুলে যায়।
- শরীরে র্যাশ তেমন একটা হয় না বললেই চলে।
- তীব্র মাথা ব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা হয়।
- এই রোগে রক্তের প্লাটিলেট কমে যাওয়া বা রক্তক্ষরণ হয় না।
- রোগী শক সিনড্রোমে চলে যাওয়া অথবা এই রোগে মৃত্যুঝুঁকি একদমই নেই।
- অনেক সময় চিকুনগুনিয়া রোগে আক্রান্ত রোগীর স্কিন বা চামড়ায়ও প্রভাব পড়ে। অনেকের গায়ের রং কালো হয়ে যায়, চামড়া উঠে। ডেঙ্গুতে র্যাশ হলেও শরীরের চামড়া কালো হয়ে যায় না।
- এই রোগে মৃত্যুঝুঁকি না থাকলেও দীর্ঘমেয়াদে ভুগতে হয় আক্রান্ত রোগীকে।
- চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির লিভার, হার্ট বা কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।
- খাবারে অনীহা এই রোগের রোগীদেরও রয়েছে।
রোগ সনাক্তকরণ
ডেঙ্গু এখন আগের তুলনায় ভিন্ন প্যাটার্নে দেখা দিচ্ছে। ডেঙ্গু সাধারণত জ্বরের দুই-তিন দিনের মধ্যে টেস্ট করে শনাক্ত করা যায়। অন্যদিকে চিকুনগুনিয়া সঠিকভাবে শনাক্ত করতে হয় পাঁচ থেকে সাত দিন পর।
আইসিটি ফর চিকুনগুনিয়া টেস্ট এবং আরটি-পিসিআর টেস্টের মাধ্যমে এই রোগ শনাক্ত করা সম্ভব। এছাড়া সেরোলজি টেস্টের মাধ্যমে অ্যান্টিবডি শনাক্ত হয়।
চিকিৎসা ব্যবস্থা
ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগীদের সাধারণত সাপোর্টিভ চিকিৎসা দেওয়া হয়। জ্বর কমাতে প্যারাসিটামল এবং ব্যথা কমাতে প্রয়োজনে পেইনকিলার ব্যবহার করা হয়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ গ্রহণ করা উচিত নয়।
ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে রক্তে প্লাটিলেট ও হিমোগ্লোবিন কমে গেলে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে, কিন্তু চিকুনগুনিয়াতে সাধারণত এই সমস্যা হয় না। শুধুমাত্র জয়েন্টের ব্যথা কমাতে ব্যথানাশক দেওয়া হয়। অনেক সময় ফিজিওথেরাপিরও প্রয়োজন হতে পারে।
খাদ্য ও জীবনধারার পরামর্শ
দুই ধরনের রোগেই প্রচুর তরল খাবার খাওয়া জরুরি। ডেঙ্গু রোগীদের পানি, ডাবের পানি, শরবত, জুস, গ্লুকোজ, স্যুপ ও দুধ খেতে হয়। বমি হলে স্যালাইন দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। অন্যদিকে, চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত রোগীদের তরল খাবারের পাশাপাশি বিশেষ করে ফল খাওয়ার জরুরি।