ভোটের রাজনীতিতে নিজেদের দীর্ঘদিনের কৌশলগত দক্ষতা নিয়ে গর্বিত থাকা জামায়াতে ইসলামী (Jamaat-e-Islami) এখন যেন এক অনিশ্চিত রাজনৈতিক সংকটে পড়েছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দলটি যেখানে নেতৃত্ব দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল, সেখানে এখন তারা স্পষ্টতই ব্যাকফুটে। একদিকে রাজনৈতিক জোট গঠনের ব্যর্থতা, অন্যদিকে ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীগুলোর সমর্থন হারানো—সব মিলিয়ে নির্বাচনের আগে ক্রমেই একা হয়ে পড়ছে জামায়াত।
শুরুতে দলটি ভোটকে সামনে রেখে একটি বৃহত্তর নির্বাচনী জোট গঠনের চেষ্টা করেছিল। প্রত্যাশা ছিল, ইসলামভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি কিছু সাধারণ দলও তাদের সঙ্গে আসবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে উল্টো। কোনো সাধারণ দল তো নয়ই, ইসলামভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও কেউ জামায়াতের ডাকে সাড়া দেয়নি। এতে শুরুতেই রাজনৈতিক অঙ্গনে দলটি হোঁচট খেয়েছে।
রাজনৈতিক পরিসরের বাইরে সবচেয়ে প্রভাবশালী ধর্মীয় সংগঠন হেফাজতে ইসলাম (Hefazat-e-Islam), যেটি আনুষ্ঠানিকভাবে অরাজনৈতিক হলেও রাজপথে তাদের শক্তি ও প্রভাব অনেক আগেই প্রমাণিত। এই সংগঠনের বহু শীর্ষ নেতা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে সক্রিয় থাকলেও, আসন্ন নির্বাচনের আগে তারা জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে কোনো ধরনের জোট বা সমঝোতার ইঙ্গিত দেয়নি। বরং হেফাজত উল্টো জামায়াতের আকিদাগত অবস্থান নিয়ে সরাসরি সমালোচনায় নেমেছে। এমনকি হেফাজতের আমিরও প্রকাশ্যে জামায়াতকে লক্ষ্য করে সমালোচনামূলক মন্তব্য করে যাচ্ছেন। ফলে পরিষ্কার হয়েছে, নির্বাচনের আগে জামায়াত-হেফাজত কোনো ঘনিষ্ঠতা তৈরি হচ্ছে না।
অন্যদিকে তরুণদের নতুন দল এনসিপিকে নিয়েও হয়েছে তাদের আশাভঙ্গ। একটা সময় মনে হচ্ছিলো তরুণদের এই দলের সাথে জামায়াতের জোট বাধা শুধু সময়ের ব্যাপার। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই আশাও এখন প্রায় শেষের পথে। নতুন দল তাদের গায়ে দক্ষিনপন্থীর তকমা লাগাতে ইচ্ছুক না হওয়ায় বাধে বিপত্তি। জামায়াত অনেক ছাড় দিতে ইচ্ছুক থাকলেও সেখান থেকেও আশাহত হতে হয় দলটিকে।
এরই মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজা উপলক্ষে জামায়াত নেতাদের মন্দির পরিদর্শন ও সংশ্লিষ্ট মন্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। অনেকেই এই পদক্ষেপকে জামায়াতের রাজনৈতিক অবস্থান বদলের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখলেও, এর ফলে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও সমালোচনাও বেড়েছে।
অন্যদিকে, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও পিআর (PR) পদ্ধতির নির্বাচনের দাবিতে জামায়াতে ইসলামী যে আন্দোলন শুরু করেছিল, সেটিও এখন প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেছে। জুলাই সনদ নিয়ে সব রাজনৈতিক দলই একমত হয়েছে যে এ বিষয়ে গণভোট আয়োজন করা হবে। যদিও গণভোটের সময়সূচি নিয়ে সামান্য মতপার্থক্য রয়েছে, তবুও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সরকারের ওপরই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আলোচনার টেবিল ছেড়ে হঠাৎ রাজপথে নেমে আসা জামায়াত এখন খুঁজছে—কীভাবে সম্মানজনকভাবে রাজপথ থেকে সরে আবার ভোটের মাঠে ফেরা যায়।
আগামী ১৫ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে সব রাজনৈতিক দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে। এই স্বাক্ষর মানেই সনদের শর্ত মেনে নেওয়া, যা জামায়াতের জন্য আর কোনো অতিরিক্ত দাবি আদায়ের সুযোগ রাখছে না। ফলে এক সময়ের কৌশলগতভাবে অগ্রগামী দলটি এখন রাজনৈতিক মাঠে নিজস্ব অবস্থান ধরে রাখতেই হিমশিম খাচ্ছে।