‘সেফ এক্সিট’ নয়, জাতিরই এখন মুক্তির পথ খোঁজার সময়: ড. আসিফ নজরুল

‘বর্তমানে “সেফ এক্সিট” নিয়ে নানা আলোচনা হলেও উপদেষ্টাদের কারও এর প্রয়োজন নেই,’ এমন মন্তব্য করেছেন ড. আসিফ নজরুল (Asif Nazrul)। তিনি বলেন, এখন ব্যক্তিগত সেফ এক্সিট নয়, বরং জাতিরই একটি ‘সেফ এক্সিট’ দরকার—একটি ভয়াবহ ও আত্মধ্বংসী রাষ্ট্র কাঠামো থেকে।

শনিবার দুপুরে রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অনুষ্ঠিত ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া বিষয়ে জাতীয় পরামর্শ সভার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল।

জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা ইউএনডিপি (UNDP)-এর আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ এই পরামর্শ সভার আয়োজন করে। উদ্বোধনের পর চারটি অধিবেশনে অধ্যাদেশের খসড়া নিয়ে অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন পরামর্শ তুলে ধরেন। এর আগে বিভাগীয় পর্যায়েও এ বিষয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়।

‘জাতির সেফ এক্সিট দরকার’

ড. আসিফ নজরুল বলেন, “গত ৫৫ বছর ধরে আমরা দেখেছি দুঃশাসন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। দেখেছি ব্যাংক থেকে সাধারণ মানুষের আমানতের টাকা লুট হচ্ছে। এই ভয়াবহ, অসুস্থ, আত্মধ্বংসী রাষ্ট্র কাঠামো থেকে জাতির মুক্তি প্রয়োজন।”

তিনি আরও বলেন, “রাষ্ট্রপতি যেন স্বাধীনভাবে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করতে পারেন—বাহাত্তরের সংবিধানে এমনই বলা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে কখনোই তা হয়নি। সব সময় প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছানুযায়ীই প্রধান বিচারপতি নিয়োগ পেয়েছেন।”

বিচারব্যবস্থায় সীমাবদ্ধতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন

আইন উপদেষ্টা বলেন, “আমরা এমন প্রধান বিচারপতিও পেয়েছি, যাঁরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, গণতন্ত্র ধ্বংস করেছেন। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা দেখেও উপেক্ষা করেছেন। যাঁরা এসব করেছেন, তাঁদের শাস্তি দিতে ব্যর্থ হয়েছি।”

তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, “এমন কিছু ব্যক্তি এখনো বিচার বিভাগে রয়েছেন। আমরা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের পথে কিছুটা এগোলেও সম্পূর্ণ সফল হতে পারিনি। আগামী নির্বাচিত সরকারের দায়িত্ব থাকবে এই সংস্কার সম্পন্ন করা।”

প্রতিষ্ঠান গঠনে ব্যর্থতা

ড. আসিফ নজরুল বলেন, “ভালো ভালো আইন করা মানেই দেশ বদলে যাবে, তা নয়। অনেক ভালো আইন হয়েছে, কিন্তু যে প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আইন করা হয়, তারা টিকে না। আইন প্রণয়নে আমাদের ব্যর্থতা কম, কিন্তু প্রতিষ্ঠান গঠনে ব্যর্থতা সীমাহীন।”

তিনি আরও বলেন, “প্রতিষ্ঠান গড়া একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া। আমরা ব্যক্তিকে বুঝি, প্রতিষ্ঠানকে বুঝি না। আশা করি, এই নতুন আইন দ্বারা একটি শক্তিশালী জাতীয় মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।”

মানবাধিকার কমিশনের ভূমিকা

রাষ্ট্র কাঠামোর ভয়াবহতা থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে তিনি বলেন, “কিছু প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা জরুরি। বিশেষ করে উচ্চ আদালত, সংসদীয় কমিটি ও জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। এটি শক্তিশালী না করতে পারলে যেকোনো নাগরিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হতে পারেন।”

তিনি বলেন, “মানবাধিকার কমিশন কেবল সরকারের নয়, এটি আমাদের সবার প্রতিষ্ঠান। সংশোধিত আইনটি কমিশনের স্বাধীনতা ও দক্ষতা উভয়ই বৃদ্ধি করবে।”

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান (Adilur Rahman Khan), পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. হাফিজ আহমেদ চৌধুরী, বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইস রাষ্ট্রদূত রেতো সিগফ্রেড রেংগলি, ড্যানিশ দূতাবাসের ডেপুটি হেড অব মিশন এন্ডার্স বি কার্লসেন এবং ইউএনডিপির রেসিডেন্ট রিপ্রেজেনটেটিভ স্টেফান লিলা।

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ইউএনডিপি বাংলাদেশের আইন, বিচার ও নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা রোমানা শোয়েগার। এতে উপস্থিত ছিলেন আইন মন্ত্রণালয় ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধি এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *