পলাতক সাবেক এমপিদের বিলাসবহুল গাড়ি এখন আমলাদের ব্যবহারে

পতিত সরকারের সাবেক মন্ত্রী ও এমপিদের কোটা সুবিধায় শুল্কমুক্তভাবে আনা ৩০টি বিলাসবহুল গাড়ি অবশেষে নিলামে না তুলে হস্তান্তর করা হচ্ছে সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর (Government Transport Department)-এ। সরকারের উচ্চপর্যায়ের সমন্বিত সিদ্ধান্তে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (NBR) পক্ষ থেকে সম্প্রতি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে পাঠানো চিঠিতে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গাড়িগুলো বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের কার শেডে রয়েছে এবং কাস্টম হাউস ইতোমধ্যে দাপ্তরিক প্রক্রিয়া শুরু করেছে সেগুলো পরিবহন পুলে পাঠানোর জন্য।

সূত্র মতে, শুল্কমুক্ত সুবিধায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হয়ে মোট ৩৮টি বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি করেন সাবেক আওয়ামী লীগ (Awami League) সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা। কিন্তু ৩১টি গাড়ির ছাড়প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার আগেই সরকার পতন ঘটে এবং সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়, ফলে নিয়ম অনুযায়ী স্পিকারের প্রত্যয়নপত্র জমা দেওয়ার সুযোগ হারান সংশ্লিষ্টরা। এতে করে এই গাড়িগুলোর শুল্কমুক্ত সুবিধা আর প্রযোজ্য থাকে না।

এদিকে বন্দরের নিয়ম অনুযায়ী ৩০ দিনের মধ্যে পণ্য ছাড় না করায় গাড়িগুলোর ভবিষ্যৎ নির্ধারণে নিলাম আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয় চট্টগ্রাম কাস্টমস। নিলাম প্রক্রিয়ায় সিন্ডিকেট চক্র জড়িত হয়ে কয়েক কোটি টাকার গাড়ি মাত্র এক থেকে পাঁচ লাখ টাকার দর প্রস্তাব দেয়। প্রথম নিলামে ভিত্তিমূল্যের ৬০ শতাংশ না উঠায় দ্বিতীয় নিলাম আয়োজনের পথ খোলা ছিল, যেখানে সামান্য বেশি দর এলেই গাড়ি বিক্রি করার বাধ্যবাধকতা থাকত। এই নিয়মকে কাজে লাগিয়ে সিন্ডিকেট লাভবান হওয়ার পরিকল্পনা করছিল, যা সরকারের নজরে পড়ে।

সরকার এরপর নিলাম প্রক্রিয়া বাতিল করে বিকল্প ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। এনবিআরের কাস্টমস, রপ্তানি, বন্ড ও আইটি শাখার সদস্য কাজী মোস্তাফিজুর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে জানানো হয়, দীর্ঘদিন পড়ে থেকে গাড়িগুলোর গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে, আর নিলামে সঠিক দাম না ওঠায় এখন সরকারি সেবায় ব্যবহারের জন্য সেগুলো হস্তান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অর্থ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যৌথ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ প্রক্রিয়া দ্রুত বাস্তবায়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের উপকমিশনার এইচএম কবীর জানিয়েছেন, আমদানিকৃত ৩৮টি গাড়ির মধ্যে সাতটি গাড়ি সরকার পতনের আগেই ছাড় করা হয়, একটি গাড়ি আদালতে মামলার কারণে জিম্মায় রয়েছে, আর বাকি ৩০টি গাড়ি হস্তান্তরের চূড়ান্ত প্রক্রিয়ায় রয়েছে। তবে এমন বিকল্প ব্যবহারের নজির না থাকায় ভবিষ্যতে আইনি জটিলতার সম্ভাবনাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না বলেও জানান তিনি।

এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন চট্টগ্রাম কাস্টম বিডার অ্যাসোসিয়েশন-এর সাধারণ সম্পাদক ইয়াকুব চৌধুরী। তার দাবি, ভিত্তিমূল্য বাজারমূল্যের তুলনায় অনেক বেশি ধরা হয়েছিল বলেই তারা প্রথম নিলামে নামমাত্র দর দিয়েছেন। দ্বিতীয় নিলামে তারা ন্যায্য দর দিতে প্রস্তুত ছিলেন। সরকারের উচিত ছিল নিয়ম মেনে নিলামে অংশ নিয়ে গাড়িগুলো নিজেদের অনুকূলে নেওয়া, এতে কাস্টমসের রাজস্ব আয় হতো।

রিকন্ডিশন গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বারভিডার সাবেক সহসভাপতি গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী বলেন, শুধু এমপি কোটার গাড়িই নয়, গত ২০ বছরে আটকে থাকা আরও কয়েকশ গাড়িরও নিষ্পত্তি হয়নি। এর একটি অংশ ইতিমধ্যে স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রি হয়েছে। ফলে এমপি কোটার গাড়ির মতো অন্য গাড়িগুলোও দ্রুত নিষ্পত্তি করা উচিত, যাতে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে আনা সম্পদ নষ্ট না হয়।

এমপি কোটায় শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা এই গাড়িগুলোর মধ্যে কিছু গাড়ি সরকার পতনের ঠিক আগমুহূর্তে ছাড় করে নেন জাতীয় ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান (Shakib Al Hasan) ও ব্যারিস্টার সুমনসহ আরও পাঁচজন পলাতক এমপি ও মন্ত্রী। বাকি ৩০টি গাড়ির মালিকদের মধ্যে রয়েছেন অভিনেত্রী তারানা হালিম, জান্নাত আরা হেনরী, আবদুল ওয়াহেদ (ময়মনসিংহ), আবুল কালাম আজাদ (জামালপুর), এস আল মামুন (সীতাকুণ্ড), মুজিবুর রহমান (বাঁশখালী), এসএম কামাল হোসাইন (খুলনা), সুরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী (নওগাঁ), শাহ সারোয়ার কবির (গাইবান্ধা), এসএকে একরামুজ্জামান (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), সাজ্জাদুল হাসান (নেত্রকোনা), নাসের শাহরিয়ার জাহেদী (ঝিনাইদহ), তৌহিদুজ্জামান (যশোর) এবং মুহাম্মদ সাদিক (সুনামগঞ্জ) প্রমুখ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *