গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা: কার লাভ কার ক্ষতি??

প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস (Professor Muhammad Yunus)-এর ঘোষণায় গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একই দিনে অনুষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে তৈরি হয়েছে জটিল প্রতিক্রিয়া। আপাত দৃষ্টিতে এই ঘোষণায় জনসাধারণের তেমন আগ্রহ দেখা না গেলেও, গণভোটের চারটি পয়েন্টে রয়েছে এমন সব দিক—যা দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় রাজনীতির ভারসাম্য বদলে দিতে পারে।

এনসিপি: আংশিক সন্তুষ্টি, কিন্তু কোনো বড় প্রাপ্তি নেই

জুলাই সনদ নিয়ে এনসিপি (NCP)-র মূল দাবি ছিল—প্রেসিডেন্ট চুপ্পু নয়, বরং প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস স্বাক্ষর করবেন সনদে। এই দাবিটি পূরণ হয়নি। যদিও রাজনৈতিক মহলে আগে থেকেই গুঞ্জন ছিল, ‘শাপলা কলি’র বিনিময়ে এনসিপি এই বিষয়ে নমনীয় অবস্থান নিয়েছে।

তাদের অন্য দাবি ছিল ‘নোট অফ ডিসেন্ট’ বাদ দিয়ে পূর্ণ সনদ গণভোটে তোলা। মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণের “গ” ধারায় এই দাবির আংশিক প্রতিফলন ঘটেছে, যেখানে বলা হয়েছে—জুলাই জাতীয় সনদে ৩০টি প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমত বাস্তবায়নে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকবে।
তাছাড়া তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি ছিল “উচ্চ কক্ষে পিআর” ব্যবস্থা। এ বিষয়ে তেমন কোনো দলের বিরোধিতা দেখা যায়নি। বিএনপি মৃদু আপত্তি জানালেও বাস্তবে তারা ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিল বলেই খবর বের হয়। সব মিলিয়ে এনসিপি ঘোষণায় খুব হতাশ না হলেও, সন্তুষ্টিরও কোনো খুঁজে পাওয়া কষ্টকর।

জামায়াত: পরাজয়ের মাঝেও কিছুটা তৃপ্তি

জামায়াতে ইসলামী (Jamaat-e-Islami)-র মূল দাবি ছিল নিম্ন কক্ষে পিআর ব্যবস্থা এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট। এই দুই দাবিতেই তারা সরাসরি আন্দোলনে নামে। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ শোনার পর তাদের মনে হতে পারে, “আম-ছালা” দুটোই হারিয়েছে তারা।

তবে “খ” ধারায় উচ্চ কক্ষে পিআর সংক্রান্ত অংশে তাদের দাবির কিছুটা প্রতিফলন ঘটেছে, যা আংশিক আত্মতৃপ্তি এনে দিতে পারে। অন্যদিকে, “ক” ,“গ” ধারায় যেসব প্রস্তাব যুক্ত হয়েছে, সেগুলো তাদের মূল দাবির বাইরে হলেও, একে তারা “মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি” হিসেবেই দেখতে পারে।
যদিও জামায়াতের সমর্থকরা একে আপাত পরাজয় হিসেবে দেখতে পারে, তবুও দীর্ঘমেয়াদে ঘোষণার অন্তর্ভুক্ত কিছু বিষয় তাদের জন্য লাভজনক হতে পারে বলেই ধারণা করা যায়।

বিএনপি: সমর্থকদের খুশি, নীতিনির্ধারকদের চিন্তা

বিএনপি (BNP)-র মূল দুই দাবি ছিল—গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একই দিনে করা, এবং গণভোটে ‘নোট অফ ডিসেন্ট’ অন্তর্ভুক্ত করা। প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণায় প্রথম দাবিটি পুরোপুরি পূরণ হয়েছে। ফলে বিএনপি সমর্থকদের একটি অংশ এতে খুশি।

কিন্তু দ্বিতীয় দাবি, অর্থাৎ ‘নোট অফ ডিসেন্ট’ যুক্ত করা, তা আংশিকভাবে পূরণ হয়েছে মাত্র। ঘোষণার “ঘ” ধারায় বলা হয়েছে—জুলাই সনদে বর্ণিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাস্তবায়ন করা হবে। কিন্তু এই অংশে বিএনপির কাঙ্ক্ষিত স্পষ্টতা আসেনি।
বিশেষ করে “ক” ধারায় সন্নিবেশিত বেশ কিছু বিষয় ও “খ” ধারায় সংবিধান সংশোধনের জন্য উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদনের শর্ত বিএনপি’র জন্য ভবিষ্যতে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। তাই তাদের সাধারণ কর্মীরা খুশি হলেও, নীতিনির্ধারক পর্যায়ে কিছুটা অস্বস্তি থেকেই যাচ্ছে।

বাস্তবতার মুখে রাজনৈতিক ছাড়

রাজনীতির পুরনো সূত্র অনুযায়ী, “যার কিছু দেবার আছে, তারই কিছু হারানোর ভয় থাকে।” বর্তমান বাস্তবতায় বিএনপি একমাত্র দল যারা দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য কিছু দিতে পারে। তাই শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ছাড় দিতে হচ্ছে বিএনপিকেই —এটাই বাস্তবতা।

তবে মনে রাখতে হবে, এই গণভোট বা প্রেসিডেন্টের অধ্যাদেশ কোনোটি বাস্তবিক আইনি ভিত্তি পাবে না, যতক্ষণ না তা সংসদের মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়। অর্থাৎ, দিন শেষে নির্বাচনের ফলাফলই নির্ধারণ করবে, জুলাই সনদের কোন কোন অংশ সংবিধানে কি ভাবে স্থান পাবে, আর কোনগুলো হারিয়ে যাবে।

ড ইউনুস ভাষণে গণভোটের ধারা —

ক) নির্বাচনকালীন সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে।

খ) আগামী সংসদ হবে দুই কক্ষ বিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ জন সদস্য বিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে।

গ) সংসদে নারীর প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্থানীয় সরকার-সহ বিভিন্ন বিষয়ে যে ৩০টি প্রস্তাবে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমত হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকবে।

ঘ) জুলাই সনদে বর্ণিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হবে। গণভোটের দিন এই চারটি বিষয়ের ওপর একটিমাত্র প্রশ্নে আপনি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিয়ে আপনার মতামত জানাবেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *