তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিধান পুনরুজ্জীবিত: সর্বোচ্চ আদালতের ঐতিহাসিক রায়

সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বৈধ ঘোষণা করে, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পুনরুদ্ধারের রায় দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগ (Appellate Division)। এই রায়ের ফলে, ২০১১ সালে বাতিল হওয়া বিতর্কিত ব্যবস্থাটি আবারও কার্যকর হতে যাচ্ছে—যদিও তা বর্তমান সংসদের জন্য নয়, বরং আগামী নির্বাচন থেকে প্রয়োগ হবে।

বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ (Chief Justice Dr. Syed Refaat Ahmed)-এর নেতৃত্বে সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের বাকি বিচারপতিরা ছিলেন— মো. আশফাকুল ইসলাম, জুবায়ের রহমান চৌধুরী, মো. রেজাউল হক, এস এম ইমদাদুল হক, এ কে এম আসাদুজ্জামান এবং ফারাহ মাহবুব।

রায়ে বলা হয়, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে। তবে, চতুর্দশ সংসদ নির্বাচন থেকে কার্যকর হবে পুনরুজ্জীবিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। আদালতের ভাষ্য অনুযায়ী, এটি হবে একটি ভবিষ্যত-প্রযোজ্য সিদ্ধান্ত।

রায়ের মূল পয়েন্টসমূহ:

**পূর্বের রায় বাতিল আপিল বিভাগ একমত হয়ে পূর্বের রায়টি বাতিল ঘোষণা করেছে, যেখানে ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অসাংবিধানিক বলা হয়েছিল। সেইসাথে, সংশ্লিষ্ট সব আপিল মঞ্জুর এবং পুনর্বিবেচনার আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনরুদ্ধার: সংবিধানের চতুর্দশ খণ্ডের ২এ অধ্যায় আবার সক্রিয় করা হয়েছে। এর ফলে, ১৯৯৬ সালের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংযোজিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনরায় কার্যকর হলো।

কার্যকারিতা শর্তসাপেক্ষ: স্বয়ংক্রিয়ভাবে রায় কার্যকর হলেও, এটি কার্যকর হবে ৫৮খ(১) এবং ৫৮গ(২) ধারা প্রয়োগের ভিত্তিতে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সাংবিধানিক শর্ত পূরণ হলেই এটি কার্যকর হবে।

ভবিষ্যতের জন্য প্রযোজ্যতা: এ রায়ের প্রভাব অতীতের কোনো ঘটনার ওপর নয়, বরং এটি কেবল ভবিষ্যতের নির্বাচনের জন্য প্রযোজ্য হবে।

রাজনৈতিক ও আইনি প্রেক্ষাপট:

২০১১ সালের ১০ মে, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক (ABM Khairul Haque)-এর নেতৃত্বে আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বাতিল ঘোষণা করে। সেই রায়ে বলা হয়েছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং অগণতান্ত্রিক। যদিও প্রয়োজন বিবেচনায় ১০ম ও ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় আয়োজনের সুযোগ রাখা হয়েছিল।

রায়ের ঠিক সাত দিন পর অবসরে যান খায়রুল হক, আর অবসরের প্রায় ১৬ মাস পর ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর রায়ের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ প্রকাশ করা হয়, যাতে ওই ‘প্রয়োজন বিবেচনার’ পর্যবেক্ষণ বাদ দেওয়া হয়। এর পেছনে রায় পরিবর্তনের অভিযোগও উঠেছিল তার বিরুদ্ধে।

এই রায়ের ওপর ভিত্তি করেই আওয়ামী লীগ টানা তিনটি জাতীয় নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে পরিচালনা করে ক্ষমতায় টিকে ছিল। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, এক অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে এবং অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এরপর রায় পুনর্বিবেচনার জন্য রিভিউ আবেদন করা হয়।

আপিল ও শুনানির ধারাবাহিকতা:

চলতি বছরের ২৭ আগস্ট, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন মঞ্জুর করে আদালত এবং আপিলের অনুমতি দেয়। এরপর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর (Mirza Fakhrul Islam Alamgir), জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল গোলাম পরওয়ার এবং পাঁচ বিশিষ্ট নাগরিক আপিল করেন।

২২, ২৩, ২৮, ২৯ অক্টোবর এবং ২, ৪, ৫, ৬ ও ১১ নভেম্বর শুনানি শেষে ২০ নভেম্বর রায়ের দিন ধার্য হয়। শুনানিতে বিএনপির পক্ষে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন ও ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। জামায়াতের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো. শিশির মনির। বিশিষ্ট নাগরিকদের পক্ষে ছিলেন শরীফ ভূঁইয়া। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।

শিশির মনির বলেন, “ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সম্ভব নয়, কারণ সংসদ তো এক বছর আগেই ভেঙে গেছে। সংবিধান অনুযায়ী সংসদ ভাঙার ১৫ দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের কথা বলা হয়েছে। তাই পরবর্তী নির্বাচন, অর্থাৎ চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনই এই রায়ের আওতায় আসবে।”

পেছনের ইতিহাস:

১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকার, আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দলের আন্দোলনের চাপে সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংযোজন করে। এরপর ওই ব্যবস্থায় ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০০৪ সালে আইনজীবী এম সলিমউল্যাহসহ তিন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট করেন, যাতে ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট হাইকোর্ট রায় দেন—ত্রয়োদশ সংশোধনী বৈধ।

পরে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হলে, ২০১০ সালে শুনানি শুরু হয় এবং ২০১১ সালে বিতর্কিত রায় আসে। সেই রায় আজ পূর্ণাঙ্গভাবে পাল্টে দেওয়া হলো সর্বোচ্চ আদালতের নতুন সিদ্ধান্তে।

রায়ের তাৎপর্য:

এই রায়ের ফলে বাংলাদেশ আবারও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার ছায়ায় ফিরে গেল। রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী লড়াই এখন নতুন মাত্রায় প্রবেশ করতে যাচ্ছে, যেখানে নিরপেক্ষ নির্বাচন ও অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির পথ প্রশস্ত হতে পারে। তবে বাস্তবায়নের জন্য সাংবিধানিক ধারা অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *