আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে উত্তাপ ছড়াচ্ছে জোট গঠনের তৎপরতা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের তফসিল ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই ঘোষণার প্রস্তুতি নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তবে তফসিল ঘোষণার মাত্র ১৫ দিন আগে এসেও অন্তত চারটি বড় জোট গঠনের প্রক্রিয়া এখনো চূড়ান্ত হয়নি। শেষ মুহূর্তে আসন ভাগাভাগি, প্রতীক সংকট এবং আদর্শিক দ্বিধা—সব মিলিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো রীতিমতো এক অস্থির জটিলতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।
চার জোট গঠনের তৎপরতা
-
বিএনপি নেতৃত্বাধীন বৃহত্তর জোট:
দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি (BNP) তাদের যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেওয়া দলগুলোর সঙ্গে একটি শক্তিশালী জোট গঠনের প্রক্রিয়ায় আছে। এর আওতায় গণতন্ত্র মঞ্চ, গণঅধিকার পরিষদ, লেবার পার্টি, এলডিপি, গণফোরাম, বিজেপি, এনডিএম সহ একাধিক দলের সঙ্গে আসন সমঝোতা নিয়ে চলছে আলোচনা। যদিও বিএনপি ২৩৭টি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করেছে, তবে তাদের খালি রাখা ৬৪টি আসনের অন্তত ২৩টি আসন শরিকদের জন্য খালি রেখেছে বলে জানা গেছে। -
জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন ইসলামপন্থি জোট:
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর (Bangladesh Jamaat-e-Islami) সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের জানালেন, তারা আটটি ইসলামী দল নিয়ে একসঙ্গে নির্বাচনের মাঠে আছে এবং আসন ভাগাভাগি চূড়ান্ত করবে তফসিল ঘোষণার আগে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলাম পার্টি, জাগপা, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি প্রভৃতি দলও এই জোটে থাকছে বলে সূত্র জানায়। তবে আসন ভাগাভাগি চূড়ান্ত না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত জোটের ভাগ্য কি হবে তা নিয়ে সন্দিহান অনেকেই। বিশেষ করে জোটের নেতৃত্ব নিয়ে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে দলগুলির মধ্যে – এমনটাই জানাচ্ছে জোট সংশ্লিষ্ট অনেকেই। -
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-কেন্দ্রিক সম্ভাব্য ‘সংস্কার জোট’:
এনসিপি (NCP) এখনও বিএনপি বা জামায়াত—কোনো জোটের সঙ্গে চূড়ান্তভাবে একাত্ম হয়নি। তারা দুটি দলের সাথেই অনানুষ্ঠানিক ভাবে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। কোন পক্ষ থেকে কতটুকু ছাড় পাওয়া যায়, মূলত তার উপরি নির্ভর করছে তাদের সিদ্ধান্ত। দলটির মধ্যে একটি পক্ষ ডান মনোভাবাপন্ন হলেও মূল নেতৃত্ব জামায়াতের সাথে জোটে তেমন আগ্রহী না। বিএনপি’র সাথে জোট গঠন বা আসন ছাড়ে সমঝোতা না হলে তৃতীয় জোট গঠনের পথেই এগুতে পারে এনসিপি । দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী জানিয়েছেন, বিচার ও সংস্কারের অঙ্গীকার পেলে তারা বিএনপি বা জামায়াত—যেকোনো দলের সঙ্গে যেতে পারে। অন্যথায় এবি পার্টি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, গণসংহতি আন্দোলন প্রভৃতি দল নিয়ে তারা নিজেরাই তৃতীয় একটি ‘সংস্কার জোট’ গঠন করতে পারে। -
সিপিবি নেতৃত্বাধীন বাম ও প্রগতিশীল জোট:
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) (Communist Party of Bangladesh)-র নেতৃত্বে বাম গণতান্ত্রিক জোট, বাসদ, বাসদ (মার্কসবাদী), বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগসহ একাধিক দল মিলে একটি বামপন্থী ফ্রন্ট গঠনের চেষ্টা চলছে। সিপিবি সভাপতি সাজ্জাদ জহির চন্দন বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দলগুলো নিয়ে বৃহত্তর রাজনৈতিক ফ্রন্ট গঠনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি।” ২৫ নভেম্বর সিপিবির পক্ষ থেকে প্রার্থী তালিকা ঘোষণার কথা রয়েছে। তবে গণফোরামের মতো দল এই জোটের বিষয়ে প্রথমে আগ্রহ দেখালেও এখন আর তারা বামদের সাথে গাঁটছাড়া বাঁধতে রাজি নয়।
সংকট ও দুশ্চিন্তা
চারটি পৃথক জোট গঠনের এ তৎপরতার মাঝেও আসন ভাগাভাগি, প্রতীক সংকট, জনপ্রিয়তা ও মাটির রাজনীতির বাস্তবতা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক ছোট দল তাদের নিজস্ব প্রতীক নিয়ে ভোটে অংশ নিলে ভোট বিভক্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকছে। আবার কিছু শরিক দলের প্রতীক জনপরিচিত না হওয়ায় তাদের জয়ের সম্ভাবনা কম বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, “আমাদের প্রতীক আনারস হলেও অনেক দলের প্রতীক মানুষ চেনে না। এই সমস্যার সমাধানে আমরা নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছি।”
চূড়ান্ত হয়নি কিছুই
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “যারা যুগপৎ আন্দোলনে ছিল তাদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে। সময় আছে, চূড়ান্ত হলে জানানো হবে।” তবে শরিকরা দ্রুত সমাধান চান। এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ জানান, “আমরা পরিষ্কার বলেছি, আসন ভাগাভাগি দ্রুত সমাধান না হলে জোটের কার্যকারিতা থাকবে না।”
রাজনৈতিক মাঠে জোটের সংখ্যা বাড়লেও অন্তর্নিহিত দ্বিধা ও সংশয় জোটগুলোর স্থায়িত্ব ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। একদিকে সময় ফুরিয়ে আসছে, অন্যদিকে এখনো নিশ্চিত নয় কে কার সঙ্গে থাকবে, কে কার প্রতীকে লড়বে, এবং আদৌ ভোটারদের আস্থা পাবে কিনা—তা নিয়ে রয়েছে ঘোর অনিশ্চয়তা।


